শাহনাজ আপা বলেছিলেন, 'একদিন তোর বাসায় যাব'

শাহনাজ রহমতুল্লাহ। ছবি: খালেদ সরকার
শাহনাজ রহমতুল্লাহ। ছবি: খালেদ সরকার

আধো আধো মনে পড়ে। মফস্বলে আমার বেড়ে ওঠা। কবে ২১ ফেব্রুয়ারি, কবে ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর, সেটা বুঝতে পারতাম যখন ভোরের আলো না কাটতেই মাইকে বেজে উঠত ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’...। একটু বড় হয়ে যখন মঞ্চে গাইতে শুরু করলাম, তখন জানলাম, বিখ্যাত এই গানগুলোর শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ। এরপর কবে, কীভাবে এই শিল্পীর অসংখ্য গান মনের ভেতর বিশেষ জায়গা জুড়ে নিয়েছে, তা বুঝতে পারিনি। আমার সংগীতজীবন শুরু ২১ বছর আগে। নিজের অনেক মৌলিক গান থাকা সত্ত্বেও বরেণ্য শিল্পীদের গান গাইতে আমি ভালোবাসি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, অগ্রজদের এই গান গলায় তুলে গাওয়া তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো। মঞ্চ ও টেলিভিশনে তাই পরম ভালোবেসে তাঁদের গান গাই। একবার দেশ টিভির আমন্ত্রণে সরাসরি অনুষ্ঠানে গাইলাম অনেক জনপ্রিয় গান। এর কিছুদিন পর চ্যানেল আই–এর সরাসরি আয়োজন ‘তারকা কথন’-এ বসেছি। তারিখটি ছিল ৩০ আগস্ট। আমার জন্মদিন। অনুষ্ঠান থেকে বের হওয়ার পরই অনুষ্ঠান প্রযোজক অনন্যা রুমা আমাকে বললেন, ‘দেশ টিভি থেকে তোমাকে খুঁজছে। তোমার ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছি।’ ঠিক তখনই আমার ফোন বেজে উঠল। ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে একটি ভরাট কণ্ঠ, ‘এই মেয়ে, তোমার নাম কি মুন্নী?’ বললাম, ‘জি।’ বললেন, ‘শোনো মেয়ে, আমার নাম শাহনাজ রহমতউল্লাহ, তুমি কি কিছুদিন আগে দেশ টিভিতে আমার একটি গান গেয়েছ?’ বললাম, ‘জি।’ ভয়ে আমার তখন হাত-পা কাঁপছে। ভাবলাম তিনি এক্ষুনি বকা দেবেন। আমার বিশেষ দিন আর বিশেষ রইবে না। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন, ‘শোনো মেয়ে, এখন থেকে তুমি আমার গান গাইবে। আমি নূরকে বলেছি (আসাদুজ্জামান নূর), সে যেন তোমাকে ভালো ভালো অনুষ্ঠানে রাখে।’ এরপর ‘যাক রাখি’ বলেই ফোন রেখে দিলেন। আমার চোখ থেকে তখন ঝরছিল আনন্দাশ্রু।

মৃত্যুর একদিন আগে গত ২২ মার্চ মহড়ায় শাহনাজ রহমতুল্লাহ (বাঁয়ে), দিনাত জাহান ও ফোয়াদ নাসের বাবু
মৃত্যুর একদিন আগে গত ২২ মার্চ মহড়ায় শাহনাজ রহমতুল্লাহ (বাঁয়ে), দিনাত জাহান ও ফোয়াদ নাসের বাবু

এরপর সব অনুষ্ঠানেই আমি শাহনাজ রহমতউল্লাহর গান গাই। আর দেশের বাইরের সব অনুষ্ঠান আমি শুরু করি তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গান ‘একবার যেতে দে না’ দিয়ে। গত প্রায় তিন বছর তিনি আমাকে অনেকবার ফোন করেছেন। ২০১৬ সালে ক্যাডেট কলেজ ক্লাব আয়োজন করেছিল ‘ট্রিবিউট টু শাহনাজ রহমতউল্লাহ’। ওই অনুষ্ঠানে আমি একক শিল্পী। আমাকে গাইতে হবে শাহনাজ রহমতউল্লাহর গান। অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে কবির বকুল (গীতিকবি ও আমার স্বামী) বললেন, ‘শাহনাজ আপাকে ফোন করে দোয়া নিয়ে যাও।’ ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘শোন, আমার আসার কথা ছিল, আসতে পারছি না। তুই ভালো করে গাইবি। আর আমার বাসায় একদিন আসিস। আমার কিছু গান আছে, তোকে তুলে দেব।’ তাঁর দোয়া নিয়ে সেদিন দুই ঘণ্টা গাইলাম শুধু তাঁর গান। আয়োজকেরা শিল্পীর সম্মানে একটি ক্রেস্টও তুলে দিলেন আমার হাতে, যেন এই সম্মাননা আমি তাঁকে পৌঁছে দিই। ফোনে আপাকে বললাম, ‘আপা, কবে পৌঁছে দেব ক্রেস্টটা?’ বললেন, ‘রেখে দে তোর কাছে। যেদিন বাসায় আসবি, সেদিন নিয়ে আসিস।’ কিন্তু আর যাওয়া হয় না।

কিছুদিন আগে আমার মেসেঞ্জারে ফোন এল। নাম উঠেছে ‘শাহনাজ রহমতউল্লাহ’। সালাম দিতেই বললেন, ‘শোন, তোর দুলাভাই আমাকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছেন। ফেসবুকও হয়েছে আমার। সেখানে ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখি তোর নাম। তাই প্রথম ফোনটিই আমি তোকে দিলাম।’ তারপর অভিযোগ, ‘শোন, কে যেন আমাকে অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে বলে, “আপনি নাকি আপনার গান কেবল মুন্নীকেই গাইতে বলেছেন?” দেখ, কত বড় সাহস? আমি বলেছি, “হ্যাঁ, ও আমার গান গাইবে। নতুনেরা সবাই আমার গান গাইবে।”’ তারপর আবারও বললেন, ‘বাসায় আয়, অনেক গান আছে তুলে নিয়ে যা।’ আমার আর যাওয়া হয় না।

কিছুদিন আগে নৃত্যশিল্পী ডলি ইকবালের বাসায় দাওয়াত। গিয়ে দেখি শ্রদ্ধেয় ফেরদৌসী রহমান, শাহনাজ আপা, রেহানা আশিকুর রহমানসহ বরেণ্য অনেক শিল্পী। গানের একপর্যায়ে সবার অনুরোধে শাহনাজ আপা হারমোনিয়াম ধরে শুরু করলেন ‘খোলা জানালায়’। আহা কী কণ্ঠ! যেন বুকের ভেতর থেকে অনুভূতির শিকড়ের টান। গাইতে গাইতে হঠাৎ তিনি শিল্পী তপন চৌধুরী, আগুন, শফিক তুহিন এবং আমাকে ডেকে নিলেন। গানের একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘মুন্নী, তুইও গা।’ তাঁর পায়ের কাছে বসে গাইলাম। গান শেষে বুকে জড়িয়ে চুমু খেলেন।

৮ মার্চ। আরেকটি অনুষ্ঠানে শাহনাজ রহমতউল্লাহর অনুমতি নিয়ে তাঁর সামনে গাইলাম ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’। মঞ্চ থেকে নামার পর তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখলেন অনেকক্ষণ।

অল্প কয়েকদিন আগে ফোয়াদ নাসের বাবু (সংগীত পরিচালক) ভাই ফোনে জানালেন, দেশ টিভিতে শাহনাজ রহমতউল্লাহ ২৬ মার্চ লাইভে আসবেন। আসাদুজ্জামান নূর ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠানটিতে আমাকেও গাইতে হবে। এরপর এল শাহনাজ আপারও ফোন। বললেন, ‘দেশ টিভিতে তুইও আমার গান গাইবি। আমার বাসায় চলে আয়। গানগুলো দেখে নিবি। বাবু ভাই চাইলেন ২৪ মার্চ মহড়া করি। কিন্তু আপা বললেন, ২৪ তারিখ পারব না। ২২ মার্চ কর। তাঁর কথামতোই আমার ২২ তারিখ হারমোনিয়াম নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় তাঁর বাড়িতে হাজির। সঙ্গে নিয়ে গেলাম ক্যাডেট কলেজ থেকে তাঁর জন্য দেওয়া সেই ক্রেস্ট। তুলে দিলাম তাঁর হাতে। এরপর তাঁর সঙ্গে বসে ঠিক করলাম, অনুষ্ঠানে কোন ১১টি গান হবে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকা, খাওয়া, গাওয়া আর চলল কত গল্প। বিদায়বেলায় বললেন, ‘২৬ মার্চ সুন্দর করে সেজে আসবি। তোর জন্য আমার টেনশন হচ্ছে। তোকে আমি প্রোমোট করতে চাই।’ তারপর বললেন, ‘একদিন তোর বাসায় যাব।’ তখন আমি হঠাৎই তার পা দুটো অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম। তাঁর হাতটা ছিল আমার মাথার ওপর। আমার বুকে কী যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল, জানি না। না করা সত্ত্বেও ছয়তলা থেকে নিচে এসে গাড়ি পর্যন্ত তুলে দিয়ে গেলেন। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘সাবধানে যাস।’

সেদিনের রিহার্সেলের ৩১ ঘণ্টা পর ২৩ মার্চ রাতে তিনি চলে গেলেন। শুনেছি ‘শো মাস্ট গো অন’। আমি মানি না। কারণ বুকের ভেতর পাথর নিয়ে কি ‘খোলা জানালায়’ গাওয়া যায়? আপনার টিকচিহ্ন দেওয়া গানগুলো ২৬ মার্চ লাইভে গাইব কী করে? কথা ছিল আপনি পাশে থাকবেন। মাত্র কদিন আগে করা আপনার পরিকল্পনার সবই এখন কল্পনা। আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, ফোয়াদ নাসের বাবু—সবাই বলেছেন শাহনাজ রহমতউল্লাহর নির্দেশমতো যেন আমি ২৬ মার্চ সরাসরি গান গাই। আপা, আপনার নির্দেশ আমি মেনেছি। আমি জানি ভালোবাসার মূল্য অনেক। শেষ সময়টুকুর এই ভালোবাসা আর স্মৃতি আমার অনেক কিছু পাওয়ার, আবার হারানোরও। আমি যেমন ভাগ্যবান, তেমনই আবার দুর্ভাগাও। এই শেষ দিনের সুখ আর শোকের ভারমুক্তিতে আমি সবার শুভকামনা চাই।