বাঙালির ইংরেজি দিয়ে ইংরেজিভাষীদের মন জয় করা যাবে না

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘরে বক্তব্য দিচ্ছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: প্রথম আলো
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘরে বক্তব্য দিচ্ছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: প্রথম আলো

বাংলা সাহিত্যকে বিদেশি পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্য সৃজনশীল অনুবাদক দরকার। বাঙালির ইংরেজি দিয়ে ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকের মন জয় করা যাবে না। এমনটাই মনে করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ২১টি গল্প নিয়ে ইংরেজিতে অনূদিত ‘দ্য ক্রনিকলস অব ১৯৭১: অ্যান অ্যানথোলজি অব টোয়েন্টিওয়ান স্টোরিজ অন বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এ কথা বলেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘরে রোববার সন্ধ্যায় এই অনুষ্ঠান হয়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘রাশিয়ানরা সে দেশের বহু বই বাংলায় অনুবাদ করিয়েছে। সেসব বই পড়ে আমাদের একটা প্রজন্ম প্রায় আধা রুশ হয়ে গিয়েছিল। তারা কি রাশান লোক দিয়ে অনুবাদ করিয়েছিল? না, তারা বাংলাদেশ থেকে সৃজনশীল লেখক, ভালো অনুবাদক—এমন মানুষদের নিয়ে গিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দ্বিজেন শর্মা, হায়াৎ মামুদ, ননী ভৌমিকের মতো মানুষেরা। তাঁদের রাশিয়া নিয়ে গিয়ে ভালো ফ্ল্যাটে রেখে, ভালো বেতন দিয়ে অনুবাদগুলো করিয়ে নিয়েছিল। কারণ, রাশিয়ানরা জানত, একজন সৃজনশীল মানুষ না হলে সৃজনশীল অনুবাদ হয় না। তারা সেটা করেছিল। ওই বইগুলো বাংলা ভাষারই অংশ হয়ে গিয়েছে। আজও সেসব বই উপেক্ষিত নয়। বরং বাংলা ভাষার সম্পদে পরিণত হয়েছে।’

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, একটি জাতির ভাষা বা সাহিত্য দিয়ে যদি বিদেশ দখল করতে হয়, তাহলে দুটো জিনিস লাগে। অর্থনৈতিক যোগ্যতা ও রাজনৈতিক শক্তি। রাশিয়ার তা ছিল। চীনও কিছুদিনের মধ্যে সে রকম শুরু করে দেবে বলে মনে হয়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘রাশিয়ার বই পড়ে আমরা জেনেছিলাম, রাশিয়ার সাহিত্য খুব বড়। এবার হয়তো আমরা জানব, চীনা সাহিত্য খুব বড়। জাপানিরা সেটা না করে ভুল করেছে। সাম্রাজ্যবাদী হতে হলে শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে হয় না। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী হতে হয়। এসব কাজে বিনিয়োগ করতে হয়। টাকা খরচ করতে হয়। যার টাকা আছে, তার জিনিসই অন্য জায়গায় যায়।’

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘আমরা বাঙালিরা কয়জন ইংরেজি ভালো জানি! ব্রিটিশ বা আমেরিকান পাঠকেরা যেটাকে গ্রহণ করবে, এ রকম ইংরেজি আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভালো ছিল। ওই ইংরেজি দিয়ে ‘গীতাঞ্জলি’ পার করা গেছে। কিন্তু তার অন্য বইগুলো পার হতে পারেনি। সুতরাং বাঙালির ইংরেজি দিয়ে আমরা ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠক জয় করতে পারব না।’

দেশে ভালো অনুবাদকের সংকট প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘সাত শ বই অনুবাদের একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম। দেখি, ইংরেজি থেকে বাংলাতে অনুবাদ করার লোক নেই। কারণ, বাংলা মোটামুটি লিখতে পারেন—এমন লোক পাওয়া কঠিন। আর ইংরেজি জানেন, এমন লোক পাওয়া আরও কঠিন। এই দুই মিলে আমরা সেই কাজে খুব কমই এগোতে পেরেছি। যে বইগুলোকে ভালো অনুবাদ বলা যায়, ইংরেজি ভাষার পাঠকদের হৃদয় হরণ করবে, এ রকম অনুবাদ খুব কমই আছে।’

বাংলা সাহিত্যের মানসম্মত ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে পরামর্শও দিয়েছেন এই শিক্ষাবিদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের বহু বাঙালি বিদেশে আছেন। তাঁরা মাতৃভাষার মতো করে ইংরেজি শেখেন। কিন্তু তাঁরা বাংলাটা শেখেন কি? মাতৃভাষার মতো ইংরেজিটা শিখবেন, কিন্তু পারিবারিক পরিবেশ হবে বাঙালি। এ রকম মানুষ দিয়ে ইংরেজি অনুবাদ করানো যেতে পারে। এ রকম দু-চারজনের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা নগণ্য। আর সেটা থাকলেই যে সে ইংরেজি অনুবাদে আগ্রহী হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমার মনে হয়, এ কাজ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়। সংস্কৃতিতে টাকা খরচ করবে, এ রকম লোক পাওয়া মুশকিল। আবার বৈদেশিক সাহায্য যারা করে, তাদেরও পাওয়া সম্ভব না।’

সরকারকে সংস্কৃতি খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, বাঙালি জাতির গৌরবের যদি কোনো জায়গা থাকে, সেটা সংস্কৃতি। বাঙালি জাতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে উজ্জ্বলতা দেখিয়েছে, সেটার উৎসও কিন্তু সাংস্কৃতিক মন, যা তাকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে। সুতরাং সংস্কৃতিকে খুবই গুরুত্ব দিতে হবে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট ছিল ৬৮ কোটি টাকা। যার ৫৪ কোটি টাকা খরচ বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণে। অর্থাৎ, মাত্র ১২ কোটি টাকা মহান বঙ্গসংস্কৃতির জন্য অবদান! এই টাকা দিয়ে তো সংস্কৃতি চলে না।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, প্রায় আশাহীনতার মধ্যেও কিছু অদমিত মানুষ আছেন, যাঁরা কোনো মতেই ছাড় দিতে রাজি নন। অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের সৈয়দ জাকির হোসাইন তাঁদের অন্যতম। তাঁর মতো প্রত্যেক বড় প্রকাশক যদি সম্ভাব্য সেরা অনুবাদ নিয়ে বছরে একটি বই প্রকাশ করেন, তাহলে বিশ্ববাজারের জন্য এ দেশের কিছু বই তৈরি হয়।

বাংলাদেশি লেখক তাহমিমা আনামের বইয়ের কথা উল্লেখ করে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, তাঁর বইয়ের ইংরেজির মান ইংল্যান্ড-আমেরিকার বাজারের উপযোগী। অন্তত চার বছর তাঁর বই বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেখেছেন তিনি। ভালো সম্পাদনা ছাড়া এভাবে বই গ্রহণযোগ্য হতো না। অথচ এখানে সম্পাদনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনেই করা হয় না। কিন্তু ভালো সম্পাদনা একটি বইকে অন্য স্তরে নিয়ে যেতে পারে।

কবি আসাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমদ, লেখক আতা সরকার, নাসরীন জাহান প্রমুখ।