'নোলক' নিয়ে কাড়াকাড়ি তুঙ্গে

‘শুনলাম “নোলক” ছবিটি সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য জমা পড়েছে। কিন্তু এ ছবি নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল। সেসবের সমাধানে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি এগিয়ে আসে। পরিচালক ও প্রযোজককে ডেকে একটি প্রাথমিক সিদ্ধান্তও হয়। সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে ছবিটি জমা দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি। দুই সমিতির নেতাদের অবজ্ঞা করা হয়েছে!’

কথাগুলো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকনের। ‘নোলক’ ছবিটি সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য জমা দেওয়ায় গতকাল বুধবার দুপুরে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে এই মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন পাশেই ছিলেন সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার। মহাসচিবের বক্তব্যকে সমর্থন দিয়ে তিনি বলেন, ‘এভাবে সেন্সর বোর্ডে ছবিটি জমা দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি। শুরু থেকেই ছবিটির পরিচালক হিসেবে আমরা রাশেদ রাহাকে চিনি। কাউকে কিছু না জানিয়ে অন্য কেউ এফডিসি থেকে কীভাবে অনাপত্তিপত্র নিয়ে গেল, এটা বিস্ময়কর!’

বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘শুটিং শুরু করার আগে পরিচালক ও প্রযোজকের সুসম্পর্ক ছিল। কয়েক দফা কথা বলে বুঝতে পেরেছি, শুটিং শুরুর একপর্যায়ে পরিচালক ও প্রযোজকের মতের অমিল হয়েছে। তার মানে এই নয়, পরিচালকের নাম ছাড়াই ছবি সেন্সরে যাবে। এ ধরনের ঘটনা পরিচালকসমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের মতো। পরিচালক তার প্রাপ্য অধিকার যেন ফিরে পায়, সেই ব্যবস্থা আমরা করব।’

‘নোলক’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা শাকিব খান। পরিকল্পনামাফিক শুটিং ছাড়াই ছবিটি সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য জমা হয়েছে শুনে বেশ অবাক হয়েছেন তিনি। ‘আমি অভিনয়শিল্পী। পরিচালকের নির্দেশমতো অভিনয় করি। পরিচালক রাশেদ রাহা এই ছবির পরিচালক। ৯০ শতাংশ শুটিং তাঁর ডিরেকশনে শেষ করেছি। একটি গান আর কয়েকটি দৃশ্যে কাজ বাকি ছিল। আজ আপনার কাছে শুনছি, ছবিটি সেন্সর বোর্ডে জমা হয়েছে। কাজ শেষ করার আগে সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দেওয়ার মানে কী! বিষয়টা মোটেও ঠিক হলো না,’ বলেন শাকিব খান।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য শাহ আলম কিরণ আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যত দূর শুনেছিলাম, ছবিটি পরিচালনা করেছে রাশেদ রাহা। তার কাছে যেহেতু সব ধরনের তথ্যপ্রমাণ আছে, তাহলে অন্য নামে সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়া উচিত না। যেহেতু রাশেদ রাহা একটি চিঠি সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছে, সব সদস্য বিষয়টি পর্যালোচনা করব।’

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সচিব মমিনুল হক ‘নোলক’ সিনেমা জমা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এখনো ছবিটি দেখার শিডিউল হয়নি। প্রথম আলোকে আজ দুপুরে মমিনুল হক বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ছবিটি সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য জমা দেওয়া হয়। যাঁরা ছবিটি ছাড়পত্রের জন্য জমা দিতে এসেছিলেন, তাঁদের জানিয়ে দিয়েছি, এই ছবির সেন্সর ছাড়পত্র যাতে না দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে অভিযোগপত্র পরিচালক রাশেদ রাহা আমাদের কাছে জমা দিয়েছেন। ছবি দেখা কমিটির সদস্যদের কাছে অভিযোগপত্রটি দেব। এরপর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন, এই জটিলতা নিয়ে ছবিটি সেন্সর ছাড়পত্র পাবে কি না। আমি ওই প্রতিনিধিদলকে বলেছি দুই পক্ষ বসে সমস্যার সমাধান করে নিতে। নাইলে এই ছবি নিয়ে মামলা হতে পারে। তখন কিন্তু জটিলতা আরও বাড়বে।’

‘নোলক’ ছবির জটিলতা নিয়ে কথা বলার জন্য প্রযোজক সাকিব ইরতেজাকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এমনকি খুদে বার্তার উত্তরও দেননি। তবে ১ এপ্রিল ছবিটি নিয়ে তাঁর অবস্থান তুলে ধরতে ই–মেইলে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠান। মেইল পাওয়ার পর এ নিয়ে কথা বলতে সাকিব ইরতেজাকে হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও উত্তর দেননি। অবশ্য ই–মেইলে পাঠানো বার্তায় তিনি পরিচালক রাশেদ রাহার ব্যাপারে তাঁর অভিযোগ ও আপত্তির কথা তুলে ধরেন। প্রযোজক সাকিব ইরতেজার দাবি, পরিচালক রাশেদ রাহা তাঁর সঙ্গে অসততা করেছেন। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর পুরো বাংলাদেশের সামনে আমার ছবির পরিচালক হিসেবে রাশেদ রাহাকে পরিচয় করিয়ে দিলেও শুটিংয়ের প্রথম দিন থেকে তিনি সেই ভরসার মান রাখতে পারেননি। স্বাভাবিকভাবেই চুক্তিপত্র অনুযায়ী পরিচালক হিসেবে নিজের নাম দাবি করার অধিকার তিনি নিজেই হারিয়েছিলেন। এত কিছুর পরও তো শুধু নিজের নাম পরিচালক হিসেবে ব্যবহার করিনি আমি। এককভাবে “নোলক”-এর মতো একটি চলচ্চিত্রের পুরো কৃতিত্ব আমি নিতে পারি না। তাই পরিচালক হিসেবে ব্যবহার করেছি: সাকিব সনেট অ্যান্ড টিম। আমি এও বলছি, রাশেদ রাহার কারণে আমার দেড় কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এই টাকায় অনেকে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।’

প্রযোজক সাকিব ইরতেজার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালক রাশেদ রাহা বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, “নোলক” সিনেমার কোনো টাকাপয়সা আমার হাত দিয়ে খরচ হয়নি। প্রযোজক, নির্বাহী প্রযোজক এই কাজ করেছেন। প্রযোজক ও নায়িকা একেক সময়ে একেক কথা বলছেন, এটা বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। মূল বিষয় থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্য এখন উল্টাপাল্টা অভিযোগ করা হচ্ছে। প্রযোজকের এসব অভিযোগ যদি সত্যিই হতো, তাহলে সেসব অনেক আগেই পরিচালক সমিতি ও প্রযোজক সমিতিতে জানানো হতো। কিন্তু তাঁরা সেটা করেননি। সময় গেলে হয়তো আরও নতুন নতুন অভিযোগ শুনব, যা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। প্রযোজক “নোলক” ছবির নাম পরিবর্তন করেও সেন্সর পাওয়ার জোর চেষ্টা করছে, এ জন্য পরিচালক সমিতিতে “নোলক” চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত একটি গানের নামে “নোলক মায়ার পাখি” শিরোনামে সিনেমার নিবন্ধন করার আবেদন করে। পরিচালক সমিতি বিষয়টি বুঝতে পেরে আবেদনের বিষয়টা স্থগিত করে। দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই, এই ছবির পরিচালক আমি। আমার প্রথম পরিচালিত সিনেমা, আমার সন্তান। কোনো অবস্থায় ছবির পরিচালনায় কাউকে ভাগ বসাতে দেব না। আমার বিশ্বাস, সংশ্লিষ্ট সবাই আমার যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত বিবেচনা করে সুবিচার করবেন।’

ঢাকার একটি তারকা হোটেলে দুই বছর আগে জমকালো মহরতের পর টানা ২৮ দিন ভারতের হায়দরাবাদে ‘নোলক’ সিনেমার শুটিং করেন পরিচালক রাশেদ রাহা। শুটিং শেষে ইউনিট নিয়ে দেশে ফেরার পর পরিচালকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় প্রযোজকের। এরই জেরে পরের লট থেকে প্রযোজক সাকিব ইরতেজা পরিচালক রাশেদ রাহাকে ছাড়াই শুটিং শুরু করে দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টাপাল্টি অভিযোগে অনেক সময় পার হয়ে যায়। শুরুতে পরিচালক ও প্রযোজক সমিতিতে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করেন পরিচালক রাশেদ রাহা। অভিযোগের পর চলচ্চিত্রের দুই সমিতি একত্র হয়ে পরিচালক ও প্রযোজককে ডেকে পাঠান। মৌখিকভাবে পরিচালককে দিয়ে ছবির কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত হলেও তা মানেননি প্রযোজক। তিনি সাকিব সনেট অ্যান্ড টিমের নামে ছবির কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেন। বিষয়টি বুজতে পেরে রাশেদ রাহা তাঁর সিনেমার পরিচালকের মালিকানা ফিরে পেতে আইনের আশ্রয় নেন। ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় জিডি করেন তিনি। পরিচালকের সেই জিডির পর সিনেমার মালিকানার বিষয়টি সুরাহার জন্য ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে। সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষ যেন ছবিটির ছাড়পত্র না দেয়, তাই পরিচালক রাশেদ রাহা একটি চিঠিও দাখিল করেছেন।

২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতের হায়দরাবাদে ‘নোলক’ ছবির শুটিং শুরু হয়। শাকিব খান, ববি, মৌসুমী, ওমর সানী, তারিক আনাম খান ছাড়াও এই ছবির অভিনয়শিল্পীরা হলেন নিমা রহমান, রেবেকা, ভারতের রজতাভ দত্ত, সুপ্রিয় দত্ত, অমিতাভ ভট্টাচার্য প্রমুখ।