মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে

মঙ্গল শোভাযাত্রায় নানা রঙের মুখোশ। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম
মঙ্গল শোভাযাত্রায় নানা রঙের মুখোশ। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম

সকাল আটটা থেকেই রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হয়ে গেল লোকারণ্য। শাহবাগ মোড় পেরিয়ে চারুকলার পথটিতে মানুষ আর মানুষ। দোয়েল চত্বর, টিএসসি হয়ে দল বেঁধে আসেন শিক্ষার্থীরা।

সাড়ে আটটা। ততক্ষণে পুরো এলাকা যেন জনসমুদ্র। মানুষের কোলাহল, হর্ষধ্বনি, গান ও ঢাক–ঢোল মিলে যে ঐকতানের সৃষ্টি হয়, তাতে মুখর হয়ে ওঠে চারুকলা চত্বর। তখনো অনুষদের তিনটি গেটে তালা। ভেতরে শোভাযাত্রার প্রস্তুতি চলছে। বাইরে অপেক্ষা করছে মানুষ।

সকাল নয়টায় শুরু হয় আনন্দযজ্ঞ, মঙ্গল শোভাযাত্রা। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মিলনমেলা। ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’ স্লোগানে ১৪২৬ সনের বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়।

শোভাযাত্রায় প্যাঁচা। সকাল নয়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি বের হয়। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম
শোভাযাত্রায় প্যাঁচা। সকাল নয়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি বের হয়। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম

শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। শোভাযাত্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো হয় পুরো এলাকা। শোভাযাত্রায় নিয়ে নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানে সবকিছুই। ঢাক-ঢোলের বাদ্যি আর তালে তালে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য, হইহুল্লোড় আর আনন্দ–উল্লাস মাতিয়ে রেখেছেন পুরো শোভাযাত্রা।

চারুকলা ও ছবির হাটের মধ্যবর্তী জায়গা থেকে এগিয়ে যায় শোভাযাত্রা। সামনেই ছিল মূল শিল্পকাঠামোগুলো। এবার শোভাযাত্রার শিল্পকাঠামোগুলোর মূলটিতে বাঘের মুখ থেকে কাঁটা তোলার চিরায়ত গল্পটি উপস্থাপিত হয় বাঘ ও বকের অনুষঙ্গে। মঙ্গলের বার্তা নিয়ে ছিল প্যাঁচা। সমৃদ্ধির কথা বলছে ছাগল আর সিংহের সমন্বয়ের বিশেষ মোটিফ। লোকজ ঐতিহ্যের চিত্র মেলে ধরে গাজির পটের গাছ। এ ছাড়া অনুষঙ্গের মধ্যে ছিল দুই মাথা ঘোড়া, দুই পাখি, কাঠঠোকরা, পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় সওয়ার মানুষ। আগে–পিছে জনস্রোত। বিচিত্র, বর্ণিল, সর্পিল ঢেউ যেন। মানুষের হাতে রংবেরঙের পাখা, সরাচিত্র, বাদুড়, টিয়াসহ নানা জাতের পাখি। মুখে নানা আকৃতির মুখোশ। হর্ষধ্বনি দিয়ে এগিয়ে চলে শোভাযাত্রা। দ্রিম দ্রিম ঢোলের শব্দ। নব প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে যায় দিগ্‌বিদিক। গলা ছেড়ে ধরে গান, ‘এসো হে বৈশাখ’।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম
মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম

শোভাযাত্রার পুরো পথে সিসিটিভি ক্যামেরা আর পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। পথিমধ্যে কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারেনি। কারণ, চতুর্দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে মানবশিল্ড গঠন করা হয়েছে। গতবারের মতো এবারও ছিল মুখোশ ব্যবহার নিষিদ্ধ। ভুভুজেলা নিষিদ্ধ ছিল। নিরাপত্তার জন্য রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় কেন্দ্রীয় রাস্তা বন্ধ ছিল শোভাযাত্রার জন্য। শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় থেকে ঢাকা ক্লাব ও শিশুপার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে টিএসসি যায়। চারুকলার সামনে এসে শেষ হয় যাত্রা।

বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরুতে চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ছিল না। তখন এর নাম ছিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ১৯৯৬ সালে এর নাম হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বছর বছর বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকে আয়োজনটি, বর্ষবরণের অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

শোভাযাত্রায় বাঘ ও বকের প্রতীকী অবয়ব। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম
শোভাযাত্রায় বাঘ ও বকের প্রতীকী অবয়ব। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম

বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও কয়েক বছরের পুরোনো। ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’র আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরোনো বাদ্যসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে।