চা-বাগানের মানুষদের নিয়ে 'বাগানিয়া'

‘বাগানিয়া’ বা ‘গার্ডেন অব মেমোরিজ’ প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনীতে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন পরিচালক হুমাইরা বিলকিস। পাশে আরেক নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী
‘বাগানিয়া’ বা ‘গার্ডেন অব মেমোরিজ’ প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনীতে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন পরিচালক হুমাইরা বিলকিস। পাশে আরেক নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী

রাজধানীর গ্যেটেতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া নারী নির্মাতা হুমাইরা বিলকিসের প্রামাণ্যচিত্র ‘বাগানিয়া’ বা ‘গার্ডেন অব মেমোরিজ’। ‘থ্রু হার আইজ’ নামের নারী নির্মাতাদের এই অনন্য আয়োজন। প্রতি মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার নিয়মিত আয়োজনটি করা হচ্ছে। এবার এখানে উপস্থিত ছিলেন নির্মাতা হুমাইরা বিলকিস, তাঁর বাবা ও এই প্রামাণ্যচিত্রের অন্য শিল্পী ও কলাকুশলীরা, নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, আকরাম খান, মাহামুদুল হোসাইন, ফৌজিয়া খান, আবিদ মল্লিক, গ্যেটের পরিচালক কাস্টেন হাকেনব্রোকসহ দেশি-বিদেশি অনেক দর্শক।

নির্মাতা হুমাইরা বিলকিসের সঙ্গে এই প্রামাণ্যচিত্রের সখ্য আরও এক যুগ আগে থেকে। ২০০৭ সালে এই নির্মাতা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল শ্রীমঙ্গল থেকেও তিন ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে চাম্পারায় নামে সীমান্ত–সংলগ্ন একটা গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তখন সেখানে চা–বাগানিয়াদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে উঠতে থাকে। একসময় তাঁর মনে হয়, এই মানুষগুলোর জীবন নিয়ে সিনেমা বানাবেন। আর এক যুগ পর তৈরি হলো ‘বাগানিয়া’।

শুরুতে প্রকল্পটির নাম ছিল ‘মাই লং রোড টু স্কুল’। এই প্রকল্পের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল রীতা যাদব নামের এক নারী, যিনি চা–বাগানের কাজ ছেড়ে গ্রামের বাইরে পড়তে যান। এর মধ্যেই মারা যান তাঁর বাবা-মা। ফলে তিনি গ্রামে ফিরে এসে আবার চা–শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হন। সেই নারীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে তাঁকে একটা মুঠোফোন দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন নির্মাতা। বেঙ্গল ক্রিয়েশনসে আবেদন করেন প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরির ফান্ডের জন্য। সেই ফান্ড নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে ফিরে আসেন চা–বাগানের এই গ্রামে। ফিরে এসে দেখেন, তিনি যে ফোনটি তাঁকে দিয়েছিলেন, সেই ফোনে প্রেম করে মেয়েটা অন্য এক গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করেছেন।

হুমাইরা বিলকিসের মাথায় হাত। তাঁর ভাষায়, ‘মুখ মলিন করে চা খাই আর ঘুরে বেড়াই।’ ঘুরতে ঘুরতেই প্রামাণ্যচিত্রের বিষয় বদলে যায়, মানুষ বদলে যায়। বদলে যায় নামও। নির্মিত হয় ‘বাগানিয়া’। এই প্রামাণ্যচিত্রের কলাকুশলী কতজন? সব মিলিয়ে পাঁচজন। তা–ও আবার পাঁচজন কখনো একসঙ্গে কাজ করেননি। নির্মাতার সঙ্গে একজন বা দুজন থেকেছেন সব সময়।

গ্রামের সব ঘর মাটি দিয়ে তৈরি। একটি মাটির ঘরে তাঁরা থেকেছেন। মাটির টয়লেট। সেটিও বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। শিয়াল, সাপ, ব্যাঙে ভর্তি। সে এক অন্য জগৎ। নির্মাতার ছোটবেলার বন্ধু আর এই ছবির অন্যতম ক্রু শিশির তাই ছবির প্রথম প্রদর্শনীর এই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘হুমাইরা ছাড়া আর কারও পক্ষে এই ছবি নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না। তোমাকে ধন্যবাদ ছবিটি নির্মাণের জন্য, আমাকে সেই দলে রাখার জন্য। তা না হলে প্রকৃতির এত কাছে থেকে জীবনকে অন্যভাবে দেখার বা উপলব্ধি করার সুযোগ হতো না। জীবনের এই রূপ দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।’

এত কিছুর পরও ‘বাগানিয়া’ নির্মাণ করতে নাকি তেমন কোনো অসুবিধায় হয়নি নির্মাতার। সবার সঙ্গে হুমাইরা বিলকিসের এত সহজ আর আন্তরিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। হুমাইরা বিলকিসের ক্যামেরার সামনে তাঁরা স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছেন, ঝগড়া করেছেন।

অশীতিপর চা–শ্রমিক সরদার পদ্মলাভ বুনার্জির শেষ জীবনে ব্রিটিশ মালিকদের গুণগান করলেও তার শীর্ণ দেহের ভাষায় ধরা পড়ে বাগানের ঘেরাটোপের জীবন আর বঞ্চনার ইতিহাস। প্রত্যন্ত চা–বাগানে কাঁটাতারের মধ্যে থেকে স্কুল পালানো বালক চন্দন বের হয়ে যেতে চেষ্টা করে। চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই জেনে প্রতিদিন একই গতিতে কাজ করে যায় তরুণ শ্রমিক সরদার সজয়। এভাবেই শোষিত জীবনের একটা শিকলে দেড় শ বছর ধরে আটকা পড়ে গেছে তাদের জীবন। ২০০৭ সালে চা–শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল ২৭ টাকা। আর ২০১৮ সালে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ টাকা। এক যুগে পরিবর্তন বলতে এটুকুই।

এই চা–শ্রমিকেরা মাইগ্রেটেড জনগোষ্ঠী। গত দেড় শ বছরে জনগোষ্ঠীর সদস্যরা এতটাই মানসিকভাবে বন্দী হয়ে গেছে যে চাইলেই বন্দিত্বের শিকল থেকে মুক্ত হতে পারে না তারা। এভাবেই চলে আসছে যুগের পর যুগ। মৃত্যুই একমাত্র মুক্তির পথ। এ জন্য কেউ মারা গেলে তারা সাত দিন ধরে গান করে।

নির্মাতা হুমাইরা বিলকিস সম্প্রতি বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ডক ল্যাবে তাঁর ‘বিলকিস অ্যান্ড বিলকিস’ প্রকল্প নিয়ে ঘুরে এসেছেন। মা–মেয়ের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে নির্মিতব্য এই প্রামাণ্যচিত্রের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুদান পেয়েছেন তিনি।