'প্লিজ ভাই, একবার দেখা করার সুযোগ দেন'

তারুণ্যের জয়োৎসব অনুষ্ঠানে মুনির হাসান, মেহেদী হক, রেদওয়ান রনি, নুহাশ হুমায়ূন ও প্রীত রেজা
তারুণ্যের জয়োৎসব অনুষ্ঠানে মুনির হাসান, মেহেদী হক, রেদওয়ান রনি, নুহাশ হুমায়ূন ও প্রীত রেজা

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, এক রাতেই তিনি দেশের সেরা নির্মাতা হয়ে গেছেন। এগুলো কেবল রূপকথার গল্পেই পাওয়া যায়। সফল হওয়ার বা ভালো কাজের যে কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। তার উদাহরণ প্রথম ছবি ‘চোরাবালি’তেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী নির্মাতা রেদওয়ান রনি। গতকাল বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে তারুণ্যের জয়োৎসবের জাতীয় পর্বে রেদওয়ান রনি পাঁচ হাজার তরুণের সামনে বললেন তাঁর ‘রেদওয়ান রনি হওয়ার গল্প’। ‘শখই পেশা, পেশাই শখ’ শিরোনামের সেই পর্ব সঞ্চালনা করেন মুনির হাসান। এ সময় সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন ফটোগ্রাফার প্রীত রেজা, নির্মাতা নুহাশ হুমায়ূন ও কার্টুনিস্ট মেহেদী হক।

২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল তারুণ্যের জয়োৎসবের মঞ্চে বসে রেদওয়ান রনি চলে গেলেন ১৫ বছর পেছনে, ২০০৪ সালে। তখন তিনি একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়েন আর কম্পিউটারে ভালো ভালো সিনেমা দেখেন। তো সিনেমা দেখতে দেখতেই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ভূত গিয়ে বসল নির্মাতার ঘাড়ে। মনে হলো, হ্যাঁ, নির্মাতাই হবেন তিনি। গল্প বলবেন তিনি। আর সেই গল্প বলবেন ক্যামেরার চোখ দিয়ে। তো কীভাবে নির্মাতা হওয়া যায়?

ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কথা।

তারুণ্যের জয়োৎসব
তারুণ্যের জয়োৎসব

তখন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ব্যাচেলর জীবনে মন দিয়ে ‘ব্যাচেলর’ বানাচ্ছিলেন। রেদওয়ান রনিও আসলে ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, তাঁর নির্মাতা হতে চাওয়ার সিদ্ধান্তটা ঠিক না ভুল। নিজেকে ‘বাজিয়ে দেখার জন্য’ আল্লাহর নাম নিয়ে তিন থেকে পৃষ্ঠার বিশাল একটা ই–মেইল লিখে পাঠিয়ে দিলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ঠিকানায়। আত্মবিশ্বাস ছিল, যদি ফারুকী মেইল পড়েন, তো জবাব দেবেন। এরপর প্রতিদিনের মতো কম্পিউটার ল্যাবে বসলেন। মন নেই প্রোগ্রামিংয়ে। কিছুক্ষণ পরপর মেইলে ঢুকে রিফ্রেশ দেন উত্তর এল কি না। এভাবে এক সপ্তাহ চলে গেল। একদিন যথারীতি রিফ্রেশ দেওয়ার পর দেখলেন মেইল করেছেন ফারুকী। মেইলে পাঠিয়েছেন ফোন নম্বর। সেই দিনটি নাকি নির্মাতা রেদওয়ান রনির জীবনের সেরা দিন।

ফোন নম্বর পেয়ে রনির নতুন কাজ শুরু হলো। মেইল চেকের পর্ব রেখে শুরু করলেন ফোন করা পর্ব। কিছুদিন পরপর ফোন করেন। আর ওপাশ থেকে ফারুকী জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এই তো রনি, তোমার ই–মেলটা পড়ছি। তুমি সামনের মাসে যোগাযোগ কোরো, ১৩ তারিখ।’ ১৩ তারিখে ফোন করার পর বলেন, ‘৭ তারিখ, ৭ তারিখ।’ এভাবে পার হয়ে গেল অনেক ১৩ তারিখ, ৭ তারিখ। এভাবেই পার হয়ে গেল ছয় মাস। এরপর একদিন রেদওয়ান রনি হন্যে হয়ে ফোন করে বলেন, ‘প্লিজ ভাই, একবার দেখা করার সুযোগ দেন।’

দেখা করার সুযোগ পেলেন রেদওয়ান রনি। স্থান যথারীতি ফারুকী গ্রুপের আড্ডাঘর—আজিজ মার্কেট।

এখানে একটু বলে রাখা ভালো, এই যে ফারুকী ছয় মাস ‘ঘোরালেন’, অনেকের কাছেই এর অনেক রকম অর্থ হতে পারে। তাই সঠিক অর্থ পরিষ্কার করে দিলেন মুনির হাসান। তিনি বললেন, এই যে ফারুকী ছয় মাস ঘোরালেন, এর মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন, রনির ভেতরে আসলেই ‘লেগে থাকার মানসিকতা’ আছে কি না, একজন নির্মাতার জন্য যা অত্যন্ত জরুরি।

যা হোক, যেটা বলছিলাম। প্রথম সাক্ষাতের দিন–তারিখ ঠিক হওয়ার পর রনির তো উত্তেজনায় ঘুম হারাম। চিন্তায় অস্থির, কী পরে যাবেন তিনি! এত বড় পরিচালক বলে কথা। তো জমানো টাকা দিয়ে নতুন শার্ট কিনে ফেললেন। সেই শার্ট ইন করে ‘নায়ক নায়ক ভাব’ নিয়ে গেলেন পরিচালক হতে। আজিজ মার্কেটে গিয়ে দেখেন, ফারুকী হাফপ্যান্ট পরে ‘তুমি চেয়ে আছো তাই’ গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন রনি। একবার ভাবলেন, দ্রুত শার্টের ইন খুলে ফেলবেন!

ফারুকী প্রথম দিনই রনিকে সতর্ক করে দেন, ‘রাস্তাটা অনেক কঠিন।’ সেই কঠিন রাস্তা মেনে নিয়েই ফারুকীর সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ লুফে নেন রেদওয়ান রনি। ফারুকীকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, ‘আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না, আমি আছি।’ সেই থেকে শুরু। এখনো আছেন তিনি, বেশ দাপটের সঙ্গেই। এর পরের ঘটনা তো সবার জানা। একে একে ‘হাউজফুল’, ‘উড়োজাহাজ’, ‘শুনছেন একজন রেডিও জকির গল্প’, ‘জননী সাহসিনী ১৯৭১’, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ (যৌথ পরিচালনা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে), ‘উচ্চতর শারীরিক বিজ্ঞান’, ‘বিহাইন্ড দ্য সিন’, ‘মানিব্যাগ’, ‘ভালোবাসা ১০১’, ‘বাঘবন্দী’, ‘পাতা ঝরার দিন’, ‘আইসক্রিম’ প্রভৃতি ধারাবাহিক, বিশেষ নাটক ও চলচ্চিত্র দিয়ে জয় করেছেন দর্শকদের হৃদয়। ঝুলিতে ভরেছেন জাতীয় পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, বেস্ট ডিরেক্টর অব দ্য ইয়ারসহ অসংখ্য অ্যাওয়ার্ড।

এই লেখার জন্য যখন রেদওয়ান রনিকে ফোন করে জিজ্ঞেস করা হলো, কেন মনে হলো, নির্মাতাই হবেন? রনি বললেন, আরেকটি গল্প। যে গল্পের পটভূমি আরও আগের।

রনি ছোটবেলা থেকেই বই পড়তেন। যা পড়তেন, কল্পনায় তা দেখতেন। তখন থেকেই তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি যা দেখেন, তা অন্যকেও দেখাবেন। গল্প বলবেন তিনিও।

তখন রনি উচ্চমাধ্যমিকে পড়েন। তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু রানা। দেখতে খুবই সুন্দর। পুরো উচ্চমাধ্যমিকের সময় ধরে তাঁরা দুজনে ঠিক করলেন, রনি হবেন পরিচালক, রানা হবেন হিরো আর হবে মারমার কাটকাট সব বাংলা সিনেমা। এসব পরিকল্পনায় কেটে যেত দিনগুলো। হঠাৎ একদিন খবর এল, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন রানা। প্রিয় বন্ধুর অকালপ্রয়াণে মুষড়ে পড়লেন রনি। ঠিক করলেন, কোনো দিন আর সিনেমা বানানোর কথা ভাববেন না।

এভাবেই শোক আর হতাশায় দিনগুলো কাটছিল। বন্ধুরা অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, শোক থেকে শক্তি আর অনুপ্রেরণা নিয়েই তাঁকে কাজ করতে হবে। যেন ওপার থেকে বন্ধু রানা দেখেন আর মুচকি হাসেন। আর তাই তো একদিন ঠিক করলেন, নির্মাতাই হবেন তিনি। তাই তো রেদওয়ান রনির প্রতিটি কাজের শেষে বিশেষ কৃতজ্ঞতায় লেখা থাকে বন্ধু রানার নাম।

‘বর্তমানে কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?’ কমন এই প্রশ্ন ছুড়তেই দিলেন নতুন খবর। বিজ্ঞাপনচিত্র আর সিনেমার চিত্রনাট্যের সঙ্গে চলছে নতুন বিজনেসের কাজ! নাম দিয়েছেন ‘অরগ্যানি গ্ল্যামার’। সামনেই ওয়েব সিরিজের কাজে হাত দেবেন। এসব নিয়েই চলছে রেদওয়ান রনির দিন আর রাত।

সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটাই স্বপ্ন রেদওয়ান রনির, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরবেন বাংলাদেশকে। সেই স্বপ্ন নিয়ে পথ চলছেন, পথ চলবেন, লক্ষ্যে অটুট থেকে ছিনিয়ে আনবেন বিজয়। আর তাই তো গতকাল যখন সঞ্চালক উপস্থিত তরুণদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের মধ্য থেকে কেউ কি নির্মাতা হওয়ার জন্য রনিকে মেইল করবেন?’

হাত উঠল অনেক।