যাঁর ক্যামেরা একই সঙ্গে কবিতা আর অস্ত্র

আকরাম খান
আকরাম খান

১৯৪৭ সালে দুনিয়া একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখল। ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ নামের অর্থহীন এক মতবাদ অনুসরণ করে দুভাগ হয়ে গেল ভারত। ইতিহাস ব্যক্তির যন্ত্রণা ধরতে পারে না। সে শুধু বিজয়ী বা আধিপত্যের কলমে নির্লিপ্তভাবে লিখে যায় নাম, সাল আর ঘটনা। যেখানে থাকে না কোনো হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। সেই কাজ করেন শিল্পী। তাই ১৯৬৭ সালে হাসান আজিজুল হক লিখলেন সেই দেশভাগের প্রেক্ষাপটে একটা পরিবারের গল্প। সেই গল্প মানুষের মন জয় করল। সেই গল্প নিয়ে হলো মঞ্চ আর টিভি নাটক। সেই গল্প নিয়ে নিয়ে লেখা চিত্রনাট্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে পেল বাংলাদেশ সরকারের অনুদান। সেই ছবি মুক্তি পেল ২০১৭ সালে। পেল মেরিল প্রথম আলো সমালোচনা পুরস্কার। আর গেল ৯০তম অস্কারে।

‘খাঁচা’ নামের সেই চলচ্চিত্রের কান্ডারি আকরাম খান। আমাদের আজকের গল্পের নায়ক। অথবা শুধুই একজন সাধারণ মানুষ, যিনি নিজের দায়বদ্ধতা থেকে বলতে চান গল্প। কবিতার মতো নীরবে চিৎকার করে জানান দিতে চান যেকোনো যুদ্ধে বা ঘটনায় আক্রান্ত নারীদের শোকগাথা আর সংগ্রাম। ভয়েসলেসকে ভয়েস দিতে চান। যাদের কথা বলেনি ইতিহাস অথবা ইতিহাসের লেখক সেই বিজয়ী পুরুষ।

আকরাম খান
আকরাম খান

আকরাম খানের জন্ম ১৯৭৪ সালের ১৩ মার্চ। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। ইংল্যান্ড থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে তাঁর পোস্টিং হয় মালয়েশিয়ায়। তাই জন্ম বাংলাদেশে হলেও জন্মের পর প্রথম ছয় বছর কেটেছে মালয়েশিয়ায়। চিকিৎসক হলে কী হবে, আকরাম খানের বাবা শুনতেন বিটলস, রবিশঙ্কর বা সুচিত্রা মিত্রদের সংগীত। ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতেন। তাই জন্মের পরে পৃথিবীতে এসে প্রথমেই পরিবার আর শিল্পের সঙ্গে পরিচয় হয় আকরাম খানের। ছয় বছর বয়সে মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসার পর একসময় বয়স হলো নয় বছর। তখন একবার গেলেন দূরসম্পর্কের বোনের বাসায়। সেখানেই দেখা ‘পথের পাঁচালী’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘অপরাজিতা’ আর ‘সুবর্ণরেখা’। আকরাম খানের ভাষায়, ‘তখনই প্রথম সত্যগুলো শিল্পসম্মতভাবে সামনে এল।’ সেই থেকে শুরু। এরপর দেখেছেন একের পর ইউরোপীয়, ইরানিসহ অসংখ্য শিল্পসম্মত, জীবনঘনিষ্ঠ ও দায়বদ্ধ ছবি। এত ভালো লাগল তাঁর!

যা হোক, ছোটবেলায় তাঁর ‘ডিসলেক্সিয়া’ ছিল। ওই যে ‘তারে জামিন পার’ সিনেমায় ঈশানের যেমন ছিল, তেমনই। বোর্ডের বা বইয়ের লেখাগুলো উল্টো দেখায়। ক্লাসে শিক্ষক হয়তো পড়া বলছেন, সেটা শুনে দ্রুত সবাই খাতায় তুলে ফেলছে। তিনি পারছেন না। এ রকম। তাই ঈশানের মতো আকরাম খানের রেজাল্ট কার্ড কুকুর মুখে নিয়ে না ঘুরলেও কখনোই নাকি ‘ভালো ছাত্র’ ছিলেন না। আর রেজাল্ট ভালো না করলে যা হয় আর কী! সবাই একটু ‘অন্য রকম’ চোখে দেখত। কেউ মিশত না। একা হয়ে গিয়েছিলেন।

সেই একাকিত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে ডুব দিলেন বইয়ের জগতে। সেই শিশুটির কিন্তু ‘দ্য অ্যাতিনি অ্যাডভেঞ্চারস অব টিনটিন’ ভালো লাগত না। আশ্চর্যজনকভাবে তার ভালো লাগত কবিতা। তাঁর ভাষায়, ‘কবিতা আমাকে সেবার বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সেতার বাজানো শেষ হলেও কিছুক্ষণ যেমন তার একটা অনুরণন থাকে, কবিতাও ঠিক তেমনই। বেশির ভাগ ভালো কবিতাই অনুরণন সৃষ্টি করতে পারে।’ সে সময়, কবি আর লেখকদের সঙ্গে তাঁর একটা নীরব কথোপকথন চলত। খুলে গেল কল্পনার দুয়ার। তাই তো তাঁর প্রথম ছবি ‘ঘাসফুল’ (২০১৫) দেখে অনেক সমালোচক লিখলেন, সিনেমাটা ঠিক সিনেমার মতো না, সিনেমাটা কবিতার মতো...

আকরাম খান
আকরাম খান

প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তির অনেক আগে, ১৯৯৬ সালে বানিয়েছিলেন প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অধ্যায়’। সেই ছবির ক্যামেরায় কে ছিলেন, জানেন? ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭), ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৬৯), ‘চরিত্রহীন’ (১৯৭৫) বা ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩) ও ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ (১৯৭৭) ছবির কিংবদন্তী চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলাম। ৭০ বছর বয়সে তিনি ২২ বছর বয়সী এই তরুণ নির্মাতার আড়াই পৃষ্ঠার চিত্রনাট্য পড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। শুটিংয়ের প্রথম দিনেই হাতে ধরে শেখালেন ‘দেখা’। তাকানো আর দেখা যে এক নয়, আকরাম খান সেদিনই প্রথম বুঝেছিলেন। তাই তিনবার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া বেবী ইসলাম সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘ফলওয়ালা বৃক্ষ যে ফলভারে নুইয়ে থাকে, তা বেবী ইসলামের মতো গুণী এবং বিনয়ী মানুষকে দেখে শিখেছিলাম। আমার জীবনে তাঁর প্রভাব প্রত্যক্ষ।’

যদি প্রশ্ন আসে, আকরাম খানের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী? উত্তর হলো সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক হোক পরিবার, সহকর্মী, স্ত্রী, সন্তান বা বন্ধুদের সঙ্গে। যেকোনো সম্পর্ককে সময় দেন তিনি, লালন করেন, যত্ন নেন।

প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পর তিনি শতাধিক টিভি নাটক নির্মাণ করেছেন। কিন্তু সেখানে নাকি মন ছিল না। তবে টিভিতে কাজ করে যে উপকার হয়েছে, আকরাম খানের ভাষায়, ‘ইমেজের প্রতি আমার মোহ কেটে গেছে।’ এর অর্থ হলো, গল্প বা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এ রকম সুন্দর, নান্দনিক, নদীতে পাল তোলা নৌকার দৃশ্য ইত্যাদি যে বিনা কারণে দেখাতেই হবে, সেই লোভ থেকে সরে ‘পরিমিতিবোধ’ জন্ম নিতে পেরেছিল। দিন শেষে তাই ফিরে এসেছেন নিজের ভালোবাসার অঙ্গনে। সম্প্রতি হাসান আজিজুল হকের আরেক গল্প ‘বিধবাদের কথা’ অবলম্বনে লিখিত চিত্রনাট্য বাংলাদেশ সরকারের অনুদান পেয়েছে—পেয়েছে ৬০ লাখ টাকা।

আকরাম খান
আকরাম খান

এবার তাহলে একটু বিধবাদের কথা বলি। একাত্তর সালের প্রেক্ষাপটে এই গল্প রাহেলা আর সালেহা নামে দুই বোনের। যাদের বিয়ে হয় আবার সবর আর জবর নামে দুই ভাইয়ের সঙ্গে। সেই দুই ভাইয়ের একজন জবর রাজাকার আর সবর মুক্তিযোদ্ধা। রাহেলা আর সবরের ছেলে রাহেলিল্লাহ আবার রাজাকার। অন্যদিকে, সালেহা আর জবরের ছেলে সাহেবালি মুক্তিযোদ্ধা! তাই ঘরের ভেতরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আসে একের পর এক হত্যা, কখনো ভাই ভাইকে মারে, কখনো সন্তান পিতাকে। এসবের ভেতর দিয়ে দুই বোনের সম্পর্ক, অসহায়ত্ব আর সংগ্রামের গল্প ‘বিধবাদের কথা’!

কে হবে ‘ফরসা’ রাহেলা আর শ্যামলা ‘সালেহা’? সাহস করে প্রশ্নটা ছুড়েই দিলাম স্বয়ং পরিচালকের কাছে। বললেন, ‘রাহেলা হিসেবে আমি জয়াকে (জয়া আহসান) ভেবেছি। আর সালেহা কলকাতার পাওলি দাম। দুজনাই শুকনো, একই রকম লম্বা। বোন হিসেবে মানাবে ভালো। তবে এটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমার মনে হয়েছে, তাঁরাই চরিত্র দুটোর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ন্যায়বিচার করতে পারবেন।’

‘সিনেমা বানানোর জন্য বাজেট কত বড় সমস্যা’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গল্পটা বলতে যতটুকু লাগার, সেটুকু তো লাগবেই। কিন্তু বড় বাজেট হলেই যে ভালো ছবি হবে, আর না হলে হবে না, এটা একেবারেই ভুল কথা। বেশি বাজেট পেলে “খাঁচা” যতটুকু ভালো হয়েছে, ততটা নাও হতে পারত!’

আকরাম খান
আকরাম খান

এবার আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প একটা দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গ তুলতেই বললে, ‘এর কারণ, আমরা সাংস্কৃতিকভাবে ভয়ংকর দেউলিয়া হয়ে পড়েছি। সংস্কৃতির স্তন্য পান করেই আমাদের মনন তৈরি হয়েছে। এখন যদি সেই দুধটা বিষাক্ত হয়, তবে চিন্তা থেকে শুরু করে সবই বিষাক্ত হবে। মননে বিকৃতি এলে সবখানেই বিকৃতি আসবে। সংস্কৃতি হলো একটা দেশের কোড, ডিএনএ। এর ভেতরেই হাজার কোটি বছরের সবকিছু লেখা থাকে। আমাদের সবারই সভ্যতা টিকিয়ে রাখার দায় আছে। সেই দায় অস্বীকার করলে চলবে না।’

অনেকে বলে, আপনার সিনেমা একটু ধীর, কী বলবেন? উত্তর এল, ‘আমি দৃশ্যকে আলুভাজির মতো কাটতে চাই না। সবচেয়ে দ্রুত হলো বিজ্ঞাপন। আমি বিজ্ঞাপন বানাই না। আমি গল্প বলি। যতটুকু সময় দেওয়া প্রয়োজন, ততটা সময় দিয়ে।’

চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই সমস্যার সমাধান কী জানতে চাইলে বললেন, ‘আমাদের ভালো চলচ্চিত্র দরকার। চলচ্চিত্র থাকলে প্রেক্ষাগৃহও থাকবে। চলচ্চিত্রের জন্য দরকার ফিল্মমেকার। ফিল্মমেকার তৈরির জন্য দরকার ফিল্ম ইনস্টিটিউট। আর ফিল্ম ইনস্টিটিউটে যারা পড়বে, তাদের মন, মনন আর চোখ তৈরির জন্য দরকার চলচ্চিত্র সংসদ।। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ফিল্ম বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট ২০১৪ সালে আলোর মুখ দেখে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে। এখন সময় দিতে হবে। পরিবর্তন আসবেই।’

‘পরিবর্তন আসবেই’ বলে বিশ্বাসী মানুষটাও সেই পরিবর্তনের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অস্ত্র তাঁর ক্যামেরা।