'সুবীর বলত এখনকার ছেলেমেয়েদের ধৈর্য এত কম!'

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান ও সুবীর নন্দী
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান ও সুবীর নন্দী
সুবীর নন্দী গেয়েছেন আড়াই হাজারের বেশি গান। এর মধ্যে প্রায় দেড় শ গানের গীতিকবি ছিলেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। সুবীর নন্দীকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর তরুণ বয়সে। তাঁর লেখা অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন রফিকউজ্জামান। শিল্পী সুবীর নন্দীর সঙ্গে তাঁর ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। শিল্পীর মৃত্যুতে শোকের সঙ্গে তাঁর কথা স্মরণ করলেন খ্যাতিমান এই গীতিকবি।

সুবীর নন্দীর সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?

তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সিলেট থেকে। আমি তখন সিলেট রেডিওতে। ১৯৭৬ সালে একবার ট্যালেন্ট হান্টের জন্য হবিগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয়। সে তখন সিলেট বেতারের শিল্পী। সেখানেই তার গান শুনেছি, আড্ডা দিয়েছি। ঢাকায় আসার পর প্রথম সে আমার গান করে। সত্য সাহা এসে বললেন, একটা গান করতে হবে সাবিনার জন্য। আরেকটা করতে হবে নতুন এই ছেলেটার জন্য। আমি বললাম, এই ছেলে আমার পরিচিত। আমি তার জন্য লিখলাম, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, শত্রু বলে গণ্য হলাম’।

এই গানটা তো এখনো হিট!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ গানের সঙ্গে আমরা আরও দুটো গান করেছিলাম। একটি খন্দকার নুরুল আলমের সুরে—‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, আরেকটা ছিল ‘বধূয়ার মান ভাঙাতে জীবন গেল’। তখন আমাদের একটা পরিকল্পনা ছিল। সেটা হচ্ছে, একজন শিল্পীর দুটি বা তিনটি করে গান একসঙ্গে প্রকাশ করব। একটা না একটা তো জনপ্রিয় হবেই। সুবীরের ক্ষেত্রে দেখা গেল, তিনটি গানই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল। ১৯৭৬-৭৮ আমরা একসঙ্গে রেডিও-টেলিভিশনে বহু গান করেছি। সেগুলোর মধ্যে আছে বহু দেশের গান, আধুনিক গান। আমার লেখা ও তার গাওয়া ‘কত হাজার বছর ধরে’, ‘গলির মোড়ের ভাঙা বাড়ি’ গান দুটি অসাধারণ দুটি দেশের গান। যখন চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখতে শুরু করলাম, এমন কোনো ছবি ছিল না, যেখানে সুবীরকে দিয়ে গান করানোর কথা আমি ভাবিনি। বিশেষ করে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রগুলো। যেমন ‘দেবদাস’, ‘শুভদা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বিরাজ বৌ’। ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে’ কী চমৎকার যে সে গেয়েছে। আমার মনে হয়, সুবীর ছাড়া আর কারও পক্ষে এভাবে গানটা করা সম্ভব ছিল না। তারপর ‘চন্দ্রনাথ’ ছবির ‘অবুঝ নদীর দুই কিনার’, রামায়ণ পাঠের সঙ্গে গানটা কী দুর্দান্ত যে সে গেয়েছে ...। তারপর দেবদাসের শেষ যাত্রায় গাড়োয়ানের গান ‘মনরে ওরে মন, সুখ পাখি তোর হইল না আপন’ গানটা। বাদ্য ছাড়া গরুর গাড়ির চাকার শব্দ, গরুর গলার ঘণ্টি আর ঝিঁঝি পোকার শব্দ। ‘বিরাজ বৌ’ ছবির ‘বধূ তোমার আমার এই যে পিরিতি’ গানটির কথাও বলতে হয়।

আপনি লেখার পর তিনি কোন পর্যায়ে গিয়ে গানটি হাতে পেতেন?
অনেক সময় গান লেখার সময়ও সুবীর উপস্থিত থাকত। সুর করার সময় সুর তুলে নিত, তারপর নিজের মধ্যে সুরটা বসাত। রেকর্ডিংয়ের সময় অনুশীলন করত। এখনকার শিল্পীদের সেই সময় নেই। তারা পাগলের মতো অর্থের পেছনে ছুটছে। স্টুডিওতে গিয়ে এক লাইন সুর শুনছে আর গেয়ে দিচ্ছে। ফলে সামগ্রিকতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই শিল্পীরা গান করছে কণ্ঠ দিয়ে, সুবীর গান করত হৃদয় দিয়ে। রফিকুল আলমের ক্ষেত্রেও তাই। এই যুগে তাঁর মতো শিল্পী আমরা আর পাব না। আবার যদি কখনো সুস্থির সময় ফিরে আসে, তখন হয়তো পাওয়া যাবে। গানে যে সাধনা, ত্যাগ, আত্মনিবেদন দরকার সেটা যদি কেউ ভাবে, গানকেই যদি নিজের জীবন ভাবে, তাহলে হয়তো সুবীরের মতো শিল্পী আমরা পাব। কিন্তু আমি আর সেই ভরসা পাই না।

সুবীর নন্দীর আত্মনিবেদনের একটা গল্প বলবেন?
একবার রেকর্ডিংয়ের সময় একটা গানের এক জায়গায় উচ্চারণ ভুল হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, সুবীর একটা জায়গায় তো উচ্চারণ ভুল হয়ে গেছে। তখন রেকর্ডিংয়ের পর নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় সংশোধন করার সুযোগ ছিল না। পুরো গানটি নতুন করে গাইতে হতো। সুবীর বলল, তাহলে আমি নতুন করে গাইব। যন্ত্রশিল্পীদের সে নিজেই অনুরোধ করল। তারপর পুরো গানটা নতুন করে রেকর্ড করা হলো। এমনটা আজকাল আর দেখা যায় না।
একবার আমি একটা গান লেখা শেষ করার পর খন্দকার নুরুল আলম সাহেব পড়ছিলেন। সুবীর পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছিল। দেখে খন্দকার ভাই বললেন, ‘তোমার কথাই ভাবছিলাম, তোমাকে দিয়েই গাওয়াব।’ খন্দকার ভাই গান পেলেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন না। গান পেলে দুই–এক দিন পড়তেন। পড়তে পড়তে সুরটা মনে ধরা দিলে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন। দেখা গেল সুবীর খন্দকার ভাইয়ের পেছনে লেগে থাকতেন, কখন সুর আসবে সেই অপেক্ষায় থাকতেন। এই বিষয়গুলো কম শিল্পীর মধ্যেই পাওয়া যায়।

আপনাদের সময়ে শিল্পীর সঙ্গে গীতিকার-সুরকারদের আত্মার সম্পর্ক ছিল, যেটা আজকাল দেখা যায় না। সুবীর নন্দীদের সঙ্গে আপনারও নিশ্চয়ই সে রকমই সম্পর্ক ছিল?
সুবীর নন্দী, শাম্মী আখতার, রফিকুল আলম, শাকিলা জাফর, খন্দকার নুরুল আলম, সত্য সাহা, অনুপ ভট্টাচার্য ও আমার সম্পর্কটা ছিল পারিবারিক। প্রয়াত সত্যদা, খন্দকার ভাইদের কথা মনে পড়ে। তাঁরাও চলে গেছেন। কী অদ্ভুত সম্পর্ক যে ছিল আমাদের। এমনও হয়েছে, ঈদের দিন হয়তো সবাই আমার বা খন্দকার ভাইয়ের বাসায় জড়ো হতাম।

এখনকার শিল্পীদের ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়? সুবীরদার কী প্রতিক্রিয়া ছিল?
এখন তো কেউ শিল্পী হতে চায় না, স্টার হতে চায়। শিল্পী হতে চাইলে সাধনা লাগে। স্টার হতে চাইলে সাধনার দরকার হয় না। এখনকার শিল্পীরা দেখ শ্রোতাদের ইনভলভ করার জন্য এক মাইল দূর থেকে মাইক্রোফোন এগিয়ে দেয়। সবাই মিলে গাইলেও সেটা মাইকে শোনা যায় না। কেন এমন করে? নিজে গান গেয়ে শ্রোতাদের ইনভলভ করতে পারছে না বলে। নতুনদের নিয়ে সে একটু হতাশ ছিল। সুবীর বলত, ‘এখনকার ছেলেমেয়েদের ধৈর্য এত কম! এত যত্ন করে শেখাতে চাই। এসে কোনো রকম গানটা তুলে নিয়ে চলে যায়। আরেকবার এসে যে দেখে নেবে, সেই ধৈর্য এদের নেই।’ তবে সে আশাবাদী ছিল। বলত, ‘রফিক ভাই, আবার ভালো গান হবে।’

সুবীর নন্দীকে গানের ভেতরকার দর্শন স্পর্শ করত?
অবশ্যই করত। সে গানের মর্মের অর্থটা বুঝতে চাইত। প্রেমের গানে প্রেমিক বা প্রেমিকা কখনো একটি পুরুষ বা নারী আবার কখনো ঈশ্বর। এসব বুঝতে পারার মতো দুজন শিল্পী পেয়েছি আমি। তাদের একজন সুবীর নন্দী, আর একজন রফিকুল আলম। সাবিনাদের মধ্যেও এটা ছিল। কনকচাঁপা, এন্ড্রু কিশোরেরা এখনো বারবার একটা গান শোনে, অন্তর দিয়ে অনুভব করে গায়। সুবীর জীবনেও আমাকে বলেনি যে, আমাকে এই ধরনের একটি গান লিখে দিন। বরং আমি যেটা লিখতাম সেটা বুঝে নিতে চেষ্টা করত।

আপনার সঙ্গে শেষ কবে তাঁর কথা হয়েছিল? কী কথা হয়েছিল?
অসুস্থ হওয়ার ১০–১২ দিন আগের কথা। সুবীর আমাকে বলেছিল, আমার খুব ইচ্ছে, আপনার সঙ্গে বসে আবারও আমরা ভালো ভালো কিছু গান করি। গত রাতেই তার মেয়ের সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, সে আর বোধ হয় ফিরল না। আজ সকালে সেই খবরই পেলাম। তার মতো এমন অমর গানের শিল্পী ৫০ বা ১০০ বছরে হয়তো এক–একজন আসে। আমরা যা হারালাম, সেটা পূরণ হওয়ার নয়। আমাদের আরও কয়েকজন শিল্পী আছেন, তাঁদের যদি যত্ন না করি, তাহলে তাঁদের হারিয়েও আমাদের আফসোস করতে হবে।

সুবীর নন্দী যে এত বড় মাপের একজন শিল্পী হলেন, এর পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
আমি মনে করি, সে যে ‘সুবীর নন্দী’ হয়েছে, এর পেছনে আমাদের কোনো অবদান নেই। কেবল একটু সহযোগিতা ছিল। তার শক্তি, গুণ, ক্ষমতা ও সাধনা ছিল। এসবের বলেই সে সুবীর নন্দী হয়েছে। আমরা একটু কেবল হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমরা চাইলেই কোনো শিল্পীকে সুবীর নন্দী বানিয়ে দিতে পারব না। অনেক সময় আমরাই ধন্য হয়েছি এই কারণে যে, তারা আমাদের গানগুলো দরদ দিয়ে গেয়েছে। আমরাই বলেছি, আহা, কী সুন্দর গেয়েছে।