আরও একবার যদি সুযোগ পেতাম - মান্না দে

>বাংলা আধুনিক গানের কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে। ১ মে ছিল তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। ১৯১৯ সালের এই দিনে তিনি জন্মেছিলেন। জীবনের জলসাঘরে বইয়ে পাওয়া যায় এই মহৎ শিল্পীর জীবন। মান্না দের আত্মকথার একটি অংশ এবার থাকল পাঠকদের জন্য। জীবনসায়াহ্নের কোনো এক জন্মদিনে তিনি ফিরে দেখছিলেন নিজের জীবন।
মান্না দে। ছবি: খালেদ সরকার
মান্না দে। ছবি: খালেদ সরকার

আজ আমার জন্মদিন। আজ ১ মে।

এক বছর পর আবার ফিরে এল আমার জন্মদিন। আজ আমার বয়স আরও এক বছর বেড়ে গেল। যদিও মনের বয়স আমি একেবারেই বাড়তে দিই না কোনো দিন, তবু বয়সের হিসাবে আরও একটা বছর। বয়স তো ঠিকই বেড়ে গেল আমার। সেই কত বছর আগে এ রকমই এক দিনে আমি জন্মেছিলাম। ভাবলে অবাক হয়ে যাই, এর মধ্যেই এতগুলো বছর কেটে গেল আমার জীবনে? এই তো সেদিন পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলা আর দুষ্টুমি করে ঘুরে বেড়াতাম। এই তো সেদিন গান শেখা শুরু করলাম, সংগীতজীবন শুরু করলাম, মুম্বাই এলাম। এই তো সেদিন আমার বিয়ে হলো। রমা আর সুমিতাকে (দুই মেয়ে) মনে পড়ছে, এই কিছুদিন আগেও ছোট ছোট পা ফেলে ঘুরে বেড়াত আমাদের চারপাশে। আর এর মধ্যেই কখন যেন এতগুলো বছর চলে গেছে একেবারে নিজেরই অজান্তে। যতই চেষ্টা করি, এখন আর ফেরানো যাবে না সেই সুন্দর দিনগুলো। সেই সোনাঝরা সময়ের মালাগুলোকে। বড় একমুখী এই যাত্রা!

জন্মদিন কোনো সময়েই আমার মনে কোনো বিশেষ অনুভূতি নিয়ে আসে না। আনন্দের অনুভূতি তো নয়ই। মনে হয় আরও একটা বছর কেটে গেল, আরও অনেকটা রাস্তা হাঁটা হয়ে গেল জীবনের। এখনো কত কাজ বাকি আছে, কত কাজ অসমাপ্ত হয়ে রয়েছে। সময় কমে আসছে একটু একটু করে জীবনচক্রের গতিশীল নিয়মে। আমি তাই আমার জন্মদিনে একটু একা থাকতে চাই। একটু জীবনের হিসাব, কাজের হিসাব, একটু চাওয়া এবং পাওয়ার হিসাব মেলাতে চাই শুধু নিজেরই সঙ্গে। নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেখে নিতে চাই সমস্ত খুঁত আর আঘাতের চিহ্নগুলোকে। মনে হয়, সবকিছু যদি আমার নতুন করে শুরু করা যেত! যদি ক্যাসেট বা সিডির মতো প্রথম ট্র্যাক থেকে আবার চালানো যেত জীবনের সব পৌনঃপুনিকতা ও বিষয়কে! আরও একবার যদি সুযোগ পেতাম প্রথম থেকে আরও ভালো করে গাইতে!

আমি চুপচাপ নিজের মনে থাকতে চাইলেও, কেউ আমায় চুপচাপ থাকতে দেয় না এই জন্মদিনে। সুলোচনা (স্ত্রী) অনেক রকম রান্না করে খাওয়ায়। ও যখন রান্না করে আমায় খাওয়ায় সামনে বসে, আমার মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। মা আমাদের জন্মদিনে খুব ভালো করে পায়েস রাঁধতেন, তারপর নতুন জামা-কাপড় পরে যখন খেতে বসতাম মেঝেতে বাবু হয়ে, মা আমার পাশে জ্বেলে দিতেন পেতলের বড় পিলসুজ, প্রদীপ। তারপর তিনবার শাঁখ বাজিয়ে শাঁখটা গঙ্গাজলে ধুয়ে রেখে দিতেন একটা ছোট রেকাবে। খুব আদর করে বলতেন, ‘ভালো করে খেয়ে নাও মানা...’

মা নেই। মা চলে গেছেন সেই ১৯৮৫ সালে। কিন্তু কী জানি কেন প্রতি জন্মদিনে মাকেই বেশি করে মনে পড়ে আমার।

জন্মদিন আমার কাছে নতুন কোনো আশার খবর, আনন্দের খবর নিয়ে আসে না। একটা সাধারণ দিন হিসেবেই আসে, চলেও যায় নিঃশব্দে। এই দিনটা পারতপক্ষে আমি কোনো সভা–সমিতি বা অনুষ্ঠানে যাই না। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু সাধারণত এই দিন আমি একা থাকতে ভালোবাসি। নৈঃশব্দ্য কেটে যায় বারবার ফোনের শব্দে। রমার ফোন আসে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। ও আর ওর বর বকুল আমায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। সুমিতা আর জ্ঞান তো চলেই আসে বাড়িতে। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হয় ভালোমন্দ। ফোন করেন অন্য অনেক শুভানুধ্যায়ী। শুভেচ্ছার ফোন আসে সারা পৃথিবী থেকে।

মাঝেমধ্যে সত্যিই ভাবি, পৃথিবীর এত মানুষ আমায় ভালোবাসেন? আমার জন্য এত মানুষ ভাবেন? চিন্তা করেন? যখনই এসব ভাবি, নতুন করে ভালো লাগার প্রশান্তি ছড়ায় মনে। মনে হয়, একেবারে বিফলে বোধ হয় যায়নি জীবনের সমস্ত সময়টা।