এই দিন চিরদিন রবে

‘ফোর ডিকেডস অব ফিডব্যাক’ অনুষ্ঠানে পুরোনো ফিডব্যাককে ফিরে পান শ্রোতারা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
‘ফোর ডিকেডস অব ফিডব্যাক’ অনুষ্ঠানে পুরোনো ফিডব্যাককে ফিরে পান শ্রোতারা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ফিডব্যাক ব্যান্ডের বয়স ৪২ হতে চলেছে। চার দশকজুড়ে এই ব্যান্ড সৃষ্টি করেছে একাধিক জনপ্রিয় গান। এই আনন্দ উদ্‌যাপন করতে গত ৩০ এপ্রিল ফিডব্যাক পুরোনো ও নতুন সদস্যদের নিয়ে হাজির হয়েছিল ‘ফোর ডিকেডস অব ফিডব্যাক’ নামের এক অনুষ্ঠানে। রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সিটির ওই অনুষ্ঠান থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন মাহফুজ রহমান

গুগল ম্যাপস বলছে, ঢাকার শেরাটন হোটেল থেকে বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটির দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। জানা কথা, এখনকার শেরাটন হোটেল সত্তরের দশকের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। তো সেই পুরোনো দিনের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটির দূরত্ব কতটুকু? ফিডব্যাক ব্যান্ডকে যদি আপনি দূরত্বের হিসাবে আনেন, তাহলে কিলোমিটারে সব মাপা যাবে না। কারণ, এর দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে প্রায় ৪২ বছরের! ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে ফিডব্যাক পথচলা শুরু করেছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে। চার দশকের পথচলা উদ্‌যাপন করতে গত ৩০ এপ্রিল ফিডব্যাক গাইল বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটির ৩ নম্বর হলে। ব্যান্ডের পুরোনো সদস্য, সুর আর দর্শকের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে ফিরে এল পুরোনো দিনের স্মৃতি।

পুরোনো সুর

স্মৃতি দিয়েই শুরু হয়েছিল ‘ফোর ডিকেডস অব ফিডব্যাক’ অনুষ্ঠান। সত্তরের শেষ ও আশির দশকের শুরুর দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেসব গান বাজাত ফিডব্যাক, সেসবই তুলে আনল কণ্ঠে আর গিটারে। গাইলেন ও বাজালেন ফোয়াদ নাসের বাবু, মাকসুদ, রোমেল খান, সেলিম হায়দার ও মন্টু । ‘ভিনটেজ’ নামের এই পর্বে গানের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা খুললেন স্মৃতির ঝাঁপি। ১৯৭৫ সালে ফোয়াদ নাসের বাবু শুরু করেন ‘অস্থির’ নামের এক ব্যান্ড। সঙ্গে িছলেন পিয়ারু খান, মুন্সী নয়ন ও শামসুজ্জোহা দুলাল। সে সময় মূলত আজম খানের সঙ্গেই বাজাত এই দলটি। ১৯৭৮ সালে ‘আলট্রাসনিকস’ নামের আরেক ব্যান্ডের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ফিডব্যাক টোয়েন্টিনথ সেঞ্চুরি’। পরে অবশ্য নাম থেকে খসে পড়ে ‘টোয়েন্টিনথ সেঞ্চুরি’ অংশটি। সে সময় ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন এরশাদ মঈনুদ্দিন পপ্সি, মুরাদ রহমান, সেলিম হায়দার, কিংসলি রিক্টার, সানু রিক্টার, স্যান্ড্রা হফ, জাকিউর রহমান আর ফোয়াদ নাসের বাবু। ম্যানেজার ছিলেন হাফিজুর রহমান।

কথায় কথায় মাকসুদ বলছিলেন ‘খোকা ভাই’য়ের কথা। হাফিজুর রহমানের ডাকনাম খোকা। মাকসুদ রসিকতা করে বলছিলেন, ‘শুরুতে আমাদের কিছুই ছিল না, ছিল কেবল স্বপ্ন। আর তখন আমরা খানিকটা দুর্নীতির আশ্রয়ও নিয়েছিলাম। দুর্নীতিটা হলো খোকা ভাইয়ের কাছ থেকে ব্যান্ডের জন্য টাকা নিয়ে আর ফেরত দিতাম না।’

‘ফোর ডিকেডস অব ফিডব্যাক’–এ এসেছিলেন হাফিজুর রহমান। মাকসুদ তাঁকে ডেকে আনলেন মঞ্চে। বয়স হয়েছে কিন্তু কোথায় যেন তারুণ্যের ঝলক। চোখেমুখে গর্বের ছাপ। কথাতেও স্পষ্ট হলো সেটাই, ‘এত দীর্ঘ সময়ের সফল একটা ব্যান্ড গঠনে আমার কিছুটা হলেও যে ভূমিকা ছিল, এটা ভাবতেই গর্ব বোধ করি।’

এই সময়ে

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চে ওঠেন ফিডব্যাকের বর্তমান সদস্যরা—লাবু রহমান, লুমিন, টন্টি, রায়হান আল হাসান, মোহাম্মদ দানেশ ও ফোয়াদ নাসের বাবু। সঙ্গে থাকলেন ১৯৯৬ সালে দলছুট হয়ে যাওয়া মাকসুদ। দেখে মনেই হলো না, ফিডব্যাকের লাইনআপে মাকসুদের নামটি এখন আর লেখা হয় না। বছর কয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে মাকসুদ বলেছিলেন, ফিডব্যাক ছাড়ার পর অনেক দিন মানসিকভাবে ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেই কষ্টের ক্ষততে বুঝি উপশম হয়ে এল চার দশক পূর্তির এই আয়োজন। পুরো অনুষ্ঠানটি মাকসুদ এত গভীরভাবে ধারণ করেছিলেন যে দেখে বোঝার উপায় ছিল না, এটা ২০১৯? নাকি আশির দশকের কোনো উত্তাল সন্ধ্যা?

দর্শকের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ। আশি ও নব্বইয়ের দশকের ফিডব্যাকভক্ত, যাঁরা এখন মধ্যবয়সী, তাঁরাও যেন ওই তরুণদের সঙ্গে হারিয়ে গেলেন পুরোনো দিনে। লাবু রহমান ও ফোয়াদ নাসের বাবু বললেন, ‘দীর্ঘদিনের এই পথচলার কৃতিত্ব আপনাদেরই। আপনাদের জন্যই সবটুকু ভালোবাসা।’

ফিডব্যাকের জন্য

‘ট্রিবিউট টু ফিডব্যাক’ পর্বে মঞ্চে ওঠে দেশের আরেক জনপ্রিয় ব্যান্ড ওয়ারফেজ। গেয়ে শোনায় ফিডব্যাকের অন্যতম হিট গান ‘মৌসুমি ১’। তারপর আসে মাইলস। শাফিন ও হামিন আহমেদরাও স্মৃতিকাতর। কারণ, মাইলসের শুরুটাও ফিডব্যাকের মতোই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এবং প্রায় একই সময়ে। মাইলসের ভ্রাতৃদ্বয় অকপটে বললেন, ‘বাংলাদেশে এত দিন ধরে সাফল্যের সঙ্গে ব্যান্ড চালিয়ে যাওয়া এবং এতগুলো হিট গানের জন্ম দেওয়ার কৃতিত্ব ফিডব্যাকের।’ তাঁরা শোনালেন ‘টেলিফোনে ফিসফিস’ গানটি।

পরের গানটি আর্টসেলের। তরুণদের প্রিয় লিংকনের কণ্ঠে নিজেদের গান দর্শকসারিতে বসে শুনছিলেন ফিডব্যাকের সদস্যরা। নিজেদের সৃষ্টি তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধির কণ্ঠে শুনে তাঁরা যারপরনাই রোমাঞ্চিত। বড় পর্দায় গানের তালে তালে তাঁদের নাচানাচি ছিল বাড়তি পাওয়া। ‘ট্রিবিউট টু ফিডব্যাক’ পর্বের সব শেষ গানটি গাইল দলছুট।

ধন্যবাদ হে ভালোবাসা

অনুষ্ঠানের মাঝামাঝিতে মাকসুদ যখন ‘গীতিকবিতা ২’ গানটি গাইছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল গানের ‘ধন্যবাদ হে ভালোবাসা’ অংশটুকু যেন পুরো অনুষ্ঠানের সারসংক্ষেপ। ১৯৮৫ সালে ফিডব্যাক নামের অ্যালবামটি দিয়ে শুরু। তারপর একে একে বেরিয়েছে উল্লাস (১৯৮৭), মেলা (১৯৯০), জোয়ার (১৯৯২), বঙ্গাব্দ ১৪০০ (১৯৯৪), দেহঘড়ি (১৯৯৪), বাউলিয়ানা (১৯৯৬) আনন্দ (১৯৯৯), এই শতাব্দীর ফিডব্যাক (২০০০), শূন্য-২ (২০০২), এখন (২০১৫) নামের অ্যালবামগুলো। জনপ্রিয় গানের কথা বললে বিশাল জায়গার প্রয়োজন। পয়লা বৈশাখ আসবে আর ফিডব্যাকের ‘মেলা’ গানটি বাজবে না, তা
অসম্ভব। ‘মৌসুমি’ চরিত্রটি এখনো তরুণদের দোলা দিয়ে যায়। এ ছাড়া ফিডব্যাকের গাওয়া বাউল কিংবা সমাজসচেতনতার গানগুলোও সমৃদ্ধ করেছে বাংলাদেশের ব্যান্ডের ইতিহাস। ফিডব্যাকের প্রথম বাংলা গান ‘এই দিন চিরদিন রবে’। অনুষ্ঠান শেষেও সেই গানটির সুরই যেন বেজে চলল মনের গহিনে।