বিদেশের মাটিতে পরম প্রাপ্তি!

‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটকের একটি দৃশ্য
‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটকের একটি দৃশ্য

বিদেশের মাটিতে পরম প্রাপ্তি!‘জীবনটা আসলেই ছোট না, অনেক বড়। আর আমি পরাজিত না আমি সফল, সেটা এই সুইডেনের মাটিতে এসে উপলব্ধি করেছি। কখনো ভাবিনি, আমাদের এত কষ্টের ফসল আমরা এত পরিমাণে পাব। নাটক শেষে টানা ১০-১২ মিনিট সবাই দাঁড়িয়ে হাতে তালি, তাও আবার এমন এক দেশে, যেখানে দর্শক সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করে। এটাই তো আমার জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন থিয়েটার আর্ট ইউনিটের কর্মী নীল চৌধুরী।

সুইডেনের স্টকহোমে গত শনিবার ‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটকের সফল মঞ্চায়নের পর দর্শকের সাড়া পেয়ে নাটকের এই দলের আরেক কর্মী সঙ্গীতা চৌধুরী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সত্যিই এ এক বিরল অনুভূতি। বিদেশের মাটিতে এমন পাওয়া পরম সৌভাগ্যের!

সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের অংশ হিসেবে সুইডেনের সন্দ্রেবালস অপেরার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে ১৯ জনের দল নিয়ে স্টকহোমে যায় থিয়েটার আর্ট ইউনিট। ১০ ও ১১ মে স্টকহোমের ফ্রিয়া টি টার্ন মিলনায়তনে নাটকটির দুটি মঞ্চায়ন হয়। এই দুদিন ছিল নাটকটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় মঞ্চায়ন। আনিকা মাহিনের লেখা ‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন রোকেয়া রফিক বেবী।

স্টকহোমে নাটক মঞ্চায়নের পর দর্শকের অভিনন্দন
স্টকহোমে নাটক মঞ্চায়নের পর দর্শকের অভিনন্দন

থিয়েটার আর্ট ইউনিটের আরেক সদস্য চন্দন রেজা বলেন, ‘দুটি প্রদর্শনীতে দারুণ সাড়া পেয়েছি আমরা। শেষ প্রদর্শনীর পর গ্যালারিভরা সুইডিশ ও বাঙালি দর্শকেরা প্রায় ১৫ মিনিট ধরে করতালি আমাদের সদস্যদের আপ্লুত করেছে। ভিনদেশে দর্শকের এমন সাড়া দলের অনেক সদস্যের চোখে পানি এনেছে। সুইডেনের টিভি চ্যানেলে আমাদের “সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা” নাটক নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়।’

নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী বলেছেন, ‘নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি আমাদের দল স্টকহোমে কর্মশালা ও সেমিনারে অংশ নিচ্ছে। আমরা দেশে ফিরব ১৫ মে।’

গত ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় রাজধানীর নাটক সরণির (বেইলি রোড) মহিলা সমিতি মিলনায়তনে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়। ‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটক শুরু হয় পালা দিয়ে। গায়েন বর্ণনা শুরু করে হ্যানার জীবনগাথা। পাহাড়, হ্রদ আর তুলার মেঘের বর্ণনায় উচ্ছল কিশোরী হ্যানা। কিন্তু হঠাৎ পালার ছন্দপতন ঘটাতে আবির্ভাব হয় শাপলার। শাপলা বলতে শুরু করে তার নিজের গল্প।

হ্যানার গল্পটা তার দেশের গল্প। মায়ের গল্প, সূচিকর্মের গল্প, প্রেমের গল্প, শিল্পের জন্য ত্যাগের গল্প। গল্পের একপর্যায়ে হ্যানার প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকাপাকি, বিয়ে নিয়ে সব তোড়জোড়। কিন্তু যখন শুনতে পায় প্রেমিকের মুখে, বিয়ের পর ছেড়ে দিতে হবে তার শিল্পকর্ম, তখন এক কঠিন সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হয় হ্যানা। সে সিদ্ধান্ত নেয়, গতানুগতিক জীবন তার জন্য নয়, তার বেঁচে থাকা মায়ের দিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য নিয়ে, সূচিকর্ম নিয়ে। শিল্পের প্রতি তার প্রগাঢ় প্রেম তাকে স্থির করে শিল্পের নির্যাস নিয়ে বেঁচে থাকতে।

২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয়
২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয়

অন্যদিকে, শাপলার গল্পটা স্থানীয় দর্শকের পরিচিত গল্প। সব হারানোর গল্প, চিরায়ত লোকজ শিল্পের গল্প, ঐতিহ্য হারানোর গল্প, তার শিল্পী পরিচয় হারানোর গল্প। বাবার মৃত্যুর পর অভাবের তাড়নায় সে চলে আসে গ্রাম ছেড়ে শহরে, পেছনে ফেলে আসে তার গ্রাম, তার মা, আর নকশিকাঁথা। ফেলে আসা সুঁই-সুতার বদলে তার হাতে উঠে আসে কলের যন্ত্র। শাপলা শিল্পী থেকে হয়ে ওঠে শ্রমিক। নিজ সত্তাকে হারিয়ে শাপলা রূপান্তরিত হয় যন্ত্রে। গল্পের একপর্যায়ে শাপলার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা, অন্ধকার—হঠাৎ মায়ের মৃত্যুসংবাদ বয়ে নিয়ে আসে এক সাদা খাম। এর কিছুদিন পর শাপলা তার শরীরের ভেতর নতুন প্রাণের আভাস টের পায়। বিবাহহীন সম্পর্কের ভেতরে মাতৃত্ব? এই কঠিন প্রশ্ন তাকে ঠেলে নিয়ে যায় আত্মহত্যার পথে। পর মুহূর্তে শাপলা সিদ্ধান্ত নেয় বেঁচে থাকার। তার নিজের জন্য, অনাগত জীবনের জন্য। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। কারখানার অগ্নিকাণ্ডে শাপলার জীবন শেষ হয়।

‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা’ নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন সুজন রেজাউল, সঙ্গীতা চৌধুরী, মিতালী দাস, মেহমুদ সিদ্দিকী, নূরুজ্জামান বাবু, এস আর সম্পদ, সজল চৌধুরী, আবীর সায়েম, অপ্সরা মৌ প্রমুখ।