বয়স জেনে দেখতে হবে ছবি

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড

দেশে প্রদর্শনের জন্য যেকোনো চলচ্চিত্রের নির্মাণকাজ শেষে মুক্তির অনুমতির জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে প্রদর্শন করা হয়। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড দেশে নির্মিত এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা চলচ্চিত্র প্রদর্শন যোগ্যতা সাপেক্ষে সনদপত্র দেয়। ‘সেন্সর বোর্ড’ বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতা আমজাদ হোসেন এ বিষয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছিলেন ‘সেন্সর শব্দটিই চলচ্চিত্রকারদের জন্য অসম্মানজনক। একজন চলচ্চিত্রকার সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি অবশ্যই নিয়মকানুন মেনে কাজ করেন। তাঁর কাজ নিয়ন্ত্রণ কেন করা হবে? বরং নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।’ এখন ভারতের আদলে ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড রাখার প্রস্তাব করছেন নির্মাতা-প্রযোজকেরা।

এবার দেশি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে। তাঁদের দাবির মুখে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড’-এর নাম বদলে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ করা হচ্ছে। নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবনাটি যুক্ত করে প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’-এর খসড়া নিয়ে কিছুদিন ধরে কয়েক দফায় তথ্য মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১১ মার্চ আমরা জনসাধারণের কাছে চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করে মতামতের আহ্বান করি। ১৩ মে ছিল মতামত উপস্থাপনের শেষ দিন। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত পাওয়া গেছে। এখন সেসব নিয়ে কাজ হচ্ছে। শিগগিরই তা চূড়ান্ত হবে।’

জানা গেছে, গত অনেক বছর ধরে চলচ্চিত্র প্রযোজক-নির্মাতা-অভিনয়শিল্পীরা সেন্সর বোর্ড নাম নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সোচ্চার ছিলেন প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাক, আমজাদ হোসেন, সুভাষ দত্ত, আনোয়ার হোসেন থেকে শুরু করে অনেকেই। সমকালীন শিল্পী ও নির্মাতারা এ নিয়ে কথা বলেছেন। সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিষয়টি আমলে নেন। তাঁর উদ্যোগে আইনটির খসড়া তৈরি করা হয়। এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল এমন, সেন্সরশিপ শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয়। অনেকে ভাবেন, সেন্সর বোর্ডের কাজ শুধু কাঁচি চালানো কিন্তু সেন্সর বোর্ডের কাজ তো সার্টিফিকেট দেওয়া। মানুষের কাঠামোবদ্ধ ধারণা পরিবর্তন করতেই নাম পরিবর্তন জরুরি। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর এবারই প্রথম আলোচনায় উঠছে আইনটি। বিষয়টি এখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

কী থাকছে নতুন আইনে?
চূড়ান্ত প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’-এ সরকারের একটি অফিশিয়াল গেজেটের মাধ্যমে ‘সার্টিফিকেশন বোর্ড’ নামে সর্বোচ্চ ১৪ জন সদস্যের একটি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ বোর্ড তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সরকারি সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। এই আইনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টি তা হলো, চলচ্চিত্রের শ্রেণিবিন্যাস ও মূল্যায়নপদ্ধতি। এর মধ্যে প্রথম বিভাগটির নামকরণ হয়েছে ‘ইউএ/সর্বসাধারণের জন্য উপযোগী’। এ বিভাগে থাকবে সব বয়সী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। মূলত সামাজিক ও পারিবারিক ঘটনার চলচ্চিত্র থাকবে এ বিভাগে। পরের বিভাগটি ‘ইউ/১২ বছর বয়স পর্যন্ত’। এ বিভাগের ছবিগুলো ১২ বছরের কম বয়সী শিশুরা মা-বাবা বা অভিভাবক সঙ্গে নিয়ে দেখতে পারবে। তৃতীয় বিভাগে আছে ‘ইউ/১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী’। এ বিভাগের ছবিগুলোতে হালকা ভীতি উদ্রেককারী দৃশ্য থাকতে পারে। এ ছাড়া অল্প মাত্রায় সহিংসতা ও রোমান্টিকতা থাকতে পারে। চতুর্থ বিভাগটি হচ্ছে ‘ইউ/১৮ বছরের বেশি বয়সী’। এ বিভাগে থাকবে ১৮ বছর এবং এর বেশি বয়সী দর্শকের জন্য চলচ্চিত্র। যেখানে পরিমিত মাত্রায় সন্ত্রাস, ভয়াল দৃশ্য, যৌনতা এবং সতর্কীকরণ বাণী দিয়ে ধূমপান এবং মাদক গ্রহণের দৃশ্য থাকতে পারবে।
নতুন নীতিমালায় কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। যেমন ট্রেলার প্রকাশের জন্য বোর্ডের অনুমোদন লাগবে। এ ছাড়া পোস্টার, স্থিরচিত্র, ব্যানার, টিজার, গান, সংলাপ যেকোনো মাধ্যমে প্রচারের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান বা দাপ্তরিক কর্তৃপক্ষ অন্যান্য প্রচারসামগ্রী অনুমোদন দেবে। অনুমোদন ছাড়া সিনেমা হল, ইউটিউব বা অন্য কোথাও ট্রেলার দেখানো যাবে না। প্রস্তাবিত আইনে দেশের আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে, স্থানীয় চলচ্চিত্র স্বার্থে বা যেকোনো জাতীয় স্বার্থে সার্টিফিকেট পাওয়া চলচ্চিত্রর সার্টিফিকেট বাতিলের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গেজেট প্রকাশ করে ওই চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেট বাতিলের ঘোষণা দেবে সরকার।

আশা হতাশায় নতুন আইন
দেরিতে হলেও তথ্য মন্ত্রণালয় ও সেন্সর বোর্ডের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আইনটি কার্যকর হলে এটি চলচ্চিত্রের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সাবেক সদস্য ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও সেন্সর বোর্ড বলে কিছু নেই; সার্টিফিকেশন বোর্ড আছে। নাম পরিবর্তনের এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। আশা করি, চলচ্চিত্রের জন্য ইতিবাচক ফল আনবে।’ চিত্রনায়ক ও সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুকও আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করব এটি আইনটি শিগগিরই কার্যকর করতে। এটি হবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য একটি ইতিবাচক সূচনা।’
তবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০১৯’-এর খসড়া নিয়ে হতাশাও আছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামের মতে, নামটা পাল্টালেও বিষয়টি একই থাকছে। তেমন কোনো পার্থক্য থাকছে না। বাড়তি পাওয়া শুধু গ্রেডিং সিস্টেম। তিনি বলেন, ‘খসড়া প্রস্তাব দেখে আমরা কিছু বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলাম। যেমন ডিজিটাল ফিল্ম বা ওয়েব সিরিজে চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিদেশে ছবি পাঠানোর বিষয়ে সার্টিফিকেটের কথা বলা হয়েছে। এগুলো সংশোধন না করলে তরুণ প্রজন্ম চলচ্চিত্র নির্মাণে বিমুখ হবে।’

প্রসঙ্গত, চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইনের অধীনে ১৯৬৩ সালে ‘সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সেন্সরস’ নামে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বোর্ড’ হয় এবং একই সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ অধিদপ্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড’ সংশোধিত ১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন এবং ১৯৭৭ সালের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ বিধি অনুসারে পরিচালিত হয়ে আসছে।