'সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন বহুমুখী মননের মানুষ'

বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে কবি সিকান্দার আবু জাফর স্মরণে একক বক্তৃতা দেন কবি আসাদ চৌধুরী। ছবি: প্রথম আলো
বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে কবি সিকান্দার আবু জাফর স্মরণে একক বক্তৃতা দেন কবি আসাদ চৌধুরী। ছবি: প্রথম আলো

একজন শব্দসচেতন, সমাজসচেতন সংগ্রামী কবি সিকান্দার আবু জাফর। বক্তব্যে স্পষ্টভাষী আর মেজাজে বলিষ্ঠ হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বা ছকে বাঁধা পড়ে থাকেননি। তিনি তাঁর কাব্যের মূল সুর খুঁজেছেন সমাজ–সংঘাতের দুঃখ–বেদনার মধ্যে। তাঁর সময়ের বিকার ও অন্যায়কে একটি পরিহাস তিক্ততার মধ্যে প্রকাশ করেছেন কবিতায়।

বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে কবি সিকান্দার আবু জাফর স্মরণে একক বক্তৃতানুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন বক্তারা। আজ বুধবার দুপুরে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। ‘কবি সিকান্দার আবু জাফর ও তাঁর সময়’ শীর্ষক বক্তব্য দেন কবি আসাদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আরও উপস্থিত ছিলেন কবি রুবি রহমান, কবি কাজী রোজী, ইসরাইল খান, নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক এবং সিকান্দার আবু জাফরের কন্যা কবি সুমী সিকান্দার।

অনুষ্ঠানে একক বক্তা আসাদ চৌধুরী বলেন, সিকান্দার আবু জাফরের গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সম্পাদকীয় সর্বত্রই বাংলাদেশ ও তার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তি, মানবতার জয়গান বাঙ্‌ময় হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী এবং আন্তর্জাতিকতাবাদী। তাই সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষের সপক্ষে সোচ্চার ছিল তাঁর ক্ষুরধার কলম। তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা সমকালের সম্পাদকীয় নিবন্ধেও একজন প্রগতিশীল মানবতাবাদী লেখকের কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়। এই পত্রিকায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি বাঙালি জাতিসত্তার অনুকূলে লিখিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন অসম সাহসিকতায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত তাঁর বিখ্যাত কবিতা সংকলিত হয়েছিল ‘বাঙলা ছাড়ো’ কাব্যগ্রন্থের।

আসাদ চৌধুরী আরও বলেন, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্ভিক্ষ, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে আগাগোড়া সোচ্চার ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর। নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সব সময় তিনি ছিলেন সম্মুখসারির যোদ্ধা। জন্মশতবর্ষের শুভলগ্নে তাঁর মতো অসাধারণ কবি, গীতিকার, পথিকৃৎপ্রতিম সম্পাদক এবং সর্বোপরি অনন্য মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বের অভাব আজ বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, কবি সিকান্দার আবু জাফরের কবি ও গীতিকার সত্তা অভিন্নপ্রায়। তবে তাঁর জীবনের সেরা কীর্তি সমকাল পত্রিকা সম্পাদনা। এই পত্রিকার পাতায় পাতায় তাঁর রুচি ও সাহসের পরিচয় মুদ্রিত আছে। এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ‘বাঙলা ছাড়ো’, ‘জনতার সংগ্রাম’ কিংবা ‘আমার অভিযোগ’-এর মতো রচনা নানাভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে।

স্বাগত বক্তব্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন বহুমুখী মননের মানুষ। তাঁর কবি ও গীতিকার সত্তা উৎসর্গিত হয়েছে জনমানুষের মুক্তির আবাহনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেমন তাঁর সাহসী সাহিত্যিক ভূমিকা ছিল, তেমনি স্বল্পায়ু জীবনে তিনি মানুষের মানবিক অধিকারের পক্ষে সব সময় ছিলেন সোচ্চার। তাঁর সম্পাদিত সাহিত্যপত্র সমকাল বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে অসাধারণ উচ্চতর স্থান অধিকার করে আছে।

কবি সিকান্দার আবু জাফর ১৯১৯ সালের ১৯ মার্চ সাতক্ষীরা জেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণ নাম সৈয়দ আল্ হাশেমী আবু জাফর মুহম্মদ বখ্ত সিকান্দার। তাঁদের আদি নিবাস ছিল পাকিস্তানের পেশোয়ারে; সেখান থেকে তাঁর পিতামহ মাওলানা সৈয়দ আলম শাহ হাশেমী ওই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেন এবং পরে সিভিল সাপ্লাই অফিসে চাকরি করেন। সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘গ্লোব নিউজ এজেন্সি’ নামক সংবাদ সংস্থায়ও তিনি কাজ করেন। এ সময় তিনি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

আবু জাফর ১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং বিভিন্ন সময়ে দৈনিক নবযুগ, ইত্তেফাক, সংবাদ ও মিল্লাত পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার যে ধারা গড়ে ওঠে, আবু জাফর ছিলেন তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও বিপ্লবের চেতনাসম্পন্ন অনেক গান রচনা করেন। তাঁর রচিত ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আবু জাফর গদ্য ও পদ্য রচনায় সমান দক্ষ ছিলেন; তবে তাঁর সর্বাধিক খ্যাতি কবি হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয় এবং বনানী কবরস্থানে তিনি সমাহিত হন।