ক্যামেরা দিয়ে হুমাইরার গল্প বলা

হুমাইরা বিলকিস। ছবি: আবদুস সালাম
হুমাইরা বিলকিস। ছবি: আবদুস সালাম
হুমাইরা বিলকিসের কাছে ‘দৃশ্যকল্প নির্মাণ’ আর দশটা সাধারণ চাকরির মতো না। বরং নির্মাতা হওয়া মানে একটা ভিন্ন জীবন বেছে নেওয়া। যে জীবন ক্যামেরা দিয়ে গল্প বলে। সেই জীবনের গল্পই আমরা শুনলাম গত সপ্তাহে, প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে।

বছরের শুরুতেই হুমাইরা বিলকিস তাঁর ‘বিলকিস অ্যান্ড বিলকিস’ প্রকল্প নিয়ে ঘুরে এলেন বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ট্যালেন্ট প্রোগ্রাম থেকে। সম্প্রতি সেই প্রকল্পের জন্যই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা হিসেবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রামাণ্যচিত্র শাখায় বাংলাদেশ সরকারের অনুদান পেয়েছেন তিনি।

ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা, জেদি আর একগুঁয়ে। আগ্রহ ছিল পারফর্মিং আর্টসের দিকে। রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল থেকে ভিকারুননিসা নূন কলেজ হয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর করে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মা–বাবা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। আর অমনি বেঁকে বসলেন হুমাইরা। ঠিক করলেন, নির্মাতাই হবেন।

চাকরি ছেড়ে দিলেন। টুকটাক সিনেমা নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তখনই বাংলাদেশে আসেন অস্কারজয়ী পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত কানাডীয় চলচ্চিত্র পরিচালক শারমিন ওবায়েদ চিনয়। তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়া নারী পুলিশদের ওপর একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন। সেই প্রকল্পে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন হুমাইরা বিলকিস। এরপর ২০১৪ সালে ভারতের দিল্লিতে শ্রী অরবিন্দ সেন্টার ফর আর্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনে সৃজনশীল প্রামাণ্যচিত্রের ওপর এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করেন। সেটারই অংশ হিসেবে নির্মাণ করেন আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেটি জাপানের ইয়াগামাতা ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পেয়ে যায়।

দিল্লিতে হুমাইরা বিলকিস ‘কীভাবে একটা লোকেশন দেখতে হয় বা কীভাবে চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হয়’ এই বিষয়গুলো শিখেছিলেন। সেখানে পড়তে যাওয়ার আগেই বেঙ্গল ক্রিয়েশনসে অনুদানের জন্য আবেদন করে গিয়েছিলেন। সেই অনুদান পেয়েছিলেন তিনি। দেশে ফিরে তাই সেই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজে হাত দেন। গত ১৯ এপ্রিল রাজধানীর গ্যেটে ইনস্টিটিউটে ‘থ্রু হার আইস’–এর নিয়মিত আয়োজনে প্রদর্শিত হয় শ্রীমঙ্গলের চাম্পারায় গ্রামের চা–শ্রমিকদের জীবনের ওপর নির্মিত সেই প্রামাণ্যচিত্র, বাগানিয়া বা গার্ডেন অব মেমোরিস

বার্লিনালের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে শুরু করলেন এর আবেদনপত্র পূরণ থেকে। প্রায় ১৫ দিন লেগেছে পুরো ফরমটা পূরণ করতে। সেই অভিজ্ঞতাও নাকি দারুণ। আর বার্লিনালে গিয়ে নিজের দেশের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করাটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে চমৎকার বিষয় বলে মনে হয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যদের সংস্কৃতি জানতেও দারুণ লেগেছে হুমাইরা বিলকিসের। সেখানে যেহেতু কোনো প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল না, তাই সবাই খুব সুন্দরভাবে শিখতে পেরেছেন বলেও মনে করেন আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নির্মাতা। বার্লিনালের ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসে ৭ দিনের কর্মশালা শেষ করে নিজের প্রকল্প ‘বিলকিস অ্যান্ড বিলকিস’ পিচ (গল্প ও পরিকল্পনা শোনানো) করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখান থেকেই এই প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন ফ্রান্সের একজন প্রযোজক। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ ‘বিলকিস অ্যান্ড বিলকিস’ প্রকল্পের দৃশ্যধারণের কাজ শেষ করে সম্পাদনার কাজ শুরু করবেন
হুমাইরা। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও পড়াচ্ছেন তিনি। তাঁর মতে, ‘এখন ছবি বানিয়ে নিই, পরে যখন বয়স আর
অভিজ্ঞতা হবে, তখন পুরোপুরি শিক্ষক হয়ে যাব।’

যাঁরা নির্মাতা হতে চান, তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলার আছে কি না? প্রশ্নটার উত্তর দিলেন একটু ভিন্নভাবে। বললেন, ‘প্রত্যেকের নিজের একটা পথ থাকে, সেই পথটা খুঁজে বের করতে হবে। আমরা সব সময় অন্যের জীবনে বাঁচি। মা বা বাবার চাপিয়ে দেওয়া জীবনে বা সমাজের আরোপিত জীবন যাপন করেই অভ্যস্ত আমরা। একজন নির্মাতার নিজের জীবনে বাঁচাটা জরুরি।’