বাংলাদেশের 'বাঘা'

বাবার বন্ধু ছিলেন সাহিত্যিক আহমদ ছফা। ঘরে জমত শিল্প-সাহিত্য নিয়ে জম্পেশ আড্ডা। ছোট্ট বাঘা ঘাপটি মেরে বসে থাকত সেখানে। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আলাপ বাঘার মাথায়ও ঢোকে খানিকটা। সেখান থেকেই কি সিনেমার পোকাটা মাথায় ঢুকল? হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়েন বাঘা। এই বাঘা সত্যজিতের গুপী-বাঘা নয়। বাংলাদেশের আলাদা দুই গুপী আর বাঘা আছেন। একজন প্রযোজক, আরেকজন পরিচালক। দুজন মিলে উপহার দিয়েছেন একটা সুন্দর ছবি মাটির প্রজার দেশে। ছবিটির পরিচালক বিজন ইমতিয়াজই বাংলাদেশের বাঘা, যাঁকে নিয়ে আজকের কথকতা।
বিজন ইমতিয়াজ। ছবি: খালেদ সরকার
বিজন ইমতিয়াজ। ছবি: খালেদ সরকার

২০১৮ সালের সিনেমা মাটির প্রজার দেশে। পরিচালক ও প্রযোজক দুজনই তরুণ। তাঁরা বানিয়ে ফেললেন একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র! চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। প্রযোজক আরিফুর রহমানের খোঁজ পাই, যিনি গুপী-বাঘার ‘গুপী’। কিন্তু পরিচালক ‘বাঘা’ থেকে যান অধরা। তিনি থাকেন সুদূর মার্কিন মুলুকে। অপেক্ষা দেশে আসার। খোঁজ মেলে, রাজধানীর গ্যেটে ইনস্টিটিউটে দেখানো হবে ছবিটি। সেখানে দর্শকের প্রশ্নের উত্তর দিতে বিজন ইমতিয়াজ আসবেন। সময় নিয়ে আড্ডায় বসি একদিন।

আড্ডায় উঠে আসে বিজনের সিনেমাযাপন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবন। এফডিসি, ফিল্ম সোসাইটি, জোনাকী সিনেমা হল, মাটির প্রজার দেশে নির্মাণ, আরামবাগে সেলিমের ডিভিডির দোকান থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে পড়ানোসহ নানা কিছু। শুরু করি বর্তমান থেকে। কেমন চলছে? বিজন বলেন, ‘আমাদের ইনহাউস প্রডাকশন দুইটা। দুইটার নামই প্যারাডাইস। একই নাম রাখা হয়েছে ইচ্ছা করে। যাতে আপনারা কনফিউজড হন। একটা হলো ন্যারেটিভ, আরেকটা ডকুমেন্টারি। ডকুমেন্টারিটা করছি দুই বছর ধরে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ১০ হাজার মুসলিম পরিবারের মধ্যে মাত্র একটি হিন্দু পরিবার। সেই পরিবারকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রের গল্প।’

এটি নিয়ে তাঁরা যাচ্ছেন বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবের ফিল্ম বাজারে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এটি মুক্তি পাবে ২০২০ সালের দিকে। পাশাপাশি গুপী-বাঘা প্রডাকশন থেকেও সিনেমার নির্মাণ চলছে। সম্প্রতি খেলনা ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গুপী-বাঘা প্রযোজনা করেছে লাইভ ফ্রম ঢাকা সিনেমা। এই মুহূর্তে ফজলে রাব্বির সিনেমা ট্রি অব নলেজও প্রযোজনা করছেন তাঁরা। চলছে সম্পাদনার কাজ। এরপরই সিনেমাটির উৎসবযাত্রা নিয়ে পরিকল্পনায় নামবেন গুপী-বাঘারা। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে দুটি ছবি প্রযোজনা করার কথা চলছে। একা ওয়েটিং ফর ফ্লাড নামে দুটি সিনেমা প্রযোজনা করছে গুপী-বাঘা প্রডাকশন। কথায় কথায় জানালেন প্রযোজনা নিয়ে গতানুগতিক ভুল ধারণা নিয়েও। বিজন বলেন, ‘প্রযোজনা বলতে মানুষের একটা ভুল ধারণা আছে। প্রযোজনা ও বিনিয়োগকে গুলিয়ে ফেলা হয়। বিনিয়োগকারী হলেন যিনি টাকা লগ্নি করবেন। আর প্রযোজকের কাজ হলো লগ্নিকৃত টাকা উঠিয়ে আনা। একটা সিনেমার চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে টাকা উঠিয়ে আনা পর্যন্ত সবকিছু দেখভাল করা।’

বিএএফ শাহীন স্কুল ও কলেজ থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন বিজন। তারপর সোজা নটর ডেম কলেজ। সেখানে পড়ার সময়ই সিনেমার সঙ্গে বেশি সখ্য হয় তাঁর। প্রতি রাতে তিনটি করে সিনেমা দেখা ছিল গৎবাঁধা রুটিন। শুধু তা-ই নয়, রাজধানীর পল্টনের জোনাকী হলে হুটহাট চলে যেতেন সিনেমা দেখতে। বিজন বলেন, ‘আমি আর বন্ধু পারভেজ জোনাকী সিনেমা হলে ছবি দেখতাম। ওই সময় একটা সিডি–ডিভিডির দোকান ছিল আরামবাগে। সেলিম ভাইয়ের দোকান। সেলিম ভাই টাকা না থাকলেও আমাকে সিডি দিতেন। প্রতিদিন তিনটা করে সিনেমা দেখতাম। একটা ইংরেজি, একটা বাংলা, একটা হিন্দি অথবা অন্য দেশের সিনেমা।’ এভাবেই সিনেমার ভূতটা বিজনের মাথায় ঢোকে। এমনকি দেশের বাইরে উড়াল দেওয়ার সময়ও সেলিম ভাই বিজনের কাছে ১০ হাজার টাকা পেতেন।

বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল কলেজের পাঠ শেষ করে বিজন পড়বেন প্রকৌশল বিষয়ে। তাই ভর্তি কোচিংয়ের জন্য টাকা দিলেন বাবা-মা। কিন্তু মাথায় সিনেমার পোকা নিয়ে বিজন আর কোচিংয়ে ভর্তি হননি। তিনি বললেন, ‘আমি প্রকৌশল বিষয়ে পড়তে মোটেও আগ্রহী ছিলাম না। ভর্তি কোচিংয়ের টাকা নিয়ে মেরে দিই। পরে আমি বাবাকে বললাম, আমি দেশে থাকব না। কিন্তু বাবা রাজি হচ্ছিলেন না। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ওই সময় আমার চুল ছিল বড় বড়। শিক্ষকেরা ক্লাস থেকে বের করে দিতেন। একসময় আমি বাড়ি চলে আসি। পরে আব্বা রাজি হলেন। আমি বিদেশে উড়াল দিলাম।’

বিজন চলে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে প্রকৌশল বিষয়ে পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পরে তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এখন নিজেই পড়াচ্ছেন বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়ার সময়ই অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে লিখে ফেলেন মাটির প্রজার দেশের চিত্রনাট্য। ওই গল্পটা নিয়ে বন্ধু আরিফের সঙ্গে পরামর্শ করেন সিনেমা বানানোর। তারপর শুধুই মাটির প্রজার দেশে নিয়ে যাত্রা। ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সাল মিলে হয় শুটিং। সবকিছু শেষ করে ২০১৮ সালে ছবিটি মুক্তি পায়।

অনেক তরুণই সিনেমা নিয়ে পরামর্শ চাইতে আসেন বিজনের কাছে। বিজনের এক কথা, ‘আগে শুরু করেন। পরে কথা হবে। আমাদের দেশের লোকেরা গল্প পছন্দ করে। একজন রিকশাওয়ালা যখন কথা বলে সে-ও গল্পের মাধ্যমে বলে। ছোট বয়সে দাদা-দাদির কাছে গল্প শুনেছি। সুতরাং গল্প দরকার। তরুণদের বলি, কথা না বলে, বানিয়ে ফেলেন। একেকজন ফিল্মমেকারের জার্নি একেক রকম। আপনার মতো করেই আপনি সিনেমাটা বানান।’