বদলের বদলে যাওয়া

উইন্ড অব চেঞ্জ–এর মঞ্চে গাইছেন হাসান। ছবি: গানবাংলার সৌজন্যে
উইন্ড অব চেঞ্জ–এর মঞ্চে গাইছেন হাসান। ছবি: গানবাংলার সৌজন্যে
ভারতের কৈলাস খের, যুক্তরাষ্ট্রের গানস অ্যান্ড রোজেস ব্যান্ডের রন থাল বাম্বলফুট, বাংলাদেশের আর্ক ব্যান্ডের হাসান—তিনজন এক মঞ্চে গেয়েছেন গান। এমনটা ভাবা হয়তো বছর তিনেক আগেও খুব কঠিন লাগত। কিন্তু এখন সেই ভাবনাই বাস্তব। একই পরিবেশনায় নয়, তবে একই মঞ্চে গানের এই রথী-মহারথীরা এক হয়েছেন। সেই মঞ্চের নাম ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’। গানের দুনিয়ার বদলের হাওয়া ছড়িয়েছিল গানবাংলা চ্যানেলের এই অভিনব আয়োজনটি। তিন বছর পেরিয়ে এবার সেই বদলের পালেও লেগেছে নতুন করে বদলে যাওয়ার হাওয়া। সেই অদলবদল আর নতুন আয়োজন নিয়ে লিখেছেন মনজুর কাদের

‘উইন্ড অব চেঞ্জ’—এই একটি অনুষ্ঠানই পুরো গান বাংলা চ্যানেলের ছবি। দেশে ও বিদেশে এই আয়োজনের গানগুলো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। যে তরুণেরা একসময় নতুনত্বের স্বাদ নিতে ঝুঁকতেন কোক স্টুডিও কিংবা এমটিভি আনপ্লাগডের মতো আয়োজনের দিকে, তাঁদের প্লেলিস্টে এখন উইন্ড অব চেঞ্জের গান। এমন আলোড়ন তোলা অনুষ্ঠানের স্বপ্ন যিনি লালন করেছিলেন, তিনি কৌশিক হোসেন তাপস, গান বাংলা চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এবারের ঈদেও তিনি নতুন বদলের ডাক নিয়ে প্রস্তুত হয়েছেন। এরই মধ্যে শেষ করেছেন উইন্ড অব চেঞ্জের নতুন মৌসুমের শুটিং। এখন চলছে শুটিং পরবর্তী সম্পাদনার কাজ।

কথা–সুরে মাতাবেন যাঁরা

কথা ও সুরে এবার উইন্ড অব চেঞ্জ মঞ্চে আলো ছড়াবেন বাংলাদেশ ও ভারতের ১২ জন শিল্পী। এ মাসের প্রথম দিকে ঢাকার এফডিসিতে টানা ১০ দিন সেট বানিয়ে গানের রেকর্ডিং করা হয়। এবারের আয়োজনে দীর্ঘদিন পর দেখা মিলবে একসময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা হাসানের। থাকবেন ইউটিউবে গান প্রকাশ করে আলোচিত হওয়া মাহতিম শাকিব। বাংলাদেশের অন্য শিল্পীদের মধ্যে আছেন শাহজাহান মুন্সী, বালাম, মিজান, তন্ময় তানসেন আরেফিন রুমী। ভারত থেকে যোগ দিয়েছেন কৈলাস খের, পাপন ও অদিতি সিং শর্মা। তবে শিল্পীদের কে কোন গানটি গেয়েছেন, তা নিয়ে আপাতত কোনো কথা বলতে চাইছেন না আয়োজকদের কেউ।

একমঞ্চে ২৭ দেশের যন্ত্রশিল্পী!

এ নিয়ে উইন্ড অব চেঞ্জ–এর পাঁচটি আসর হয়েছে। ওয়ান মোর জিরো গ্রুপের টিএম প্রডাকশন প্রযোজিত অনুষ্ঠানটির প্রথম দুটিকে আয়োজক প্রতিষ্ঠান প্রাক–মৌসুম বা প্রি–সিজন বলছেন। গত তিন আসরকে মূল আসর হিসেবে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। শুরুর দিকে ভারত, রাশিয়া, লাটভিয়া, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের যন্ত্রশিল্পীরা শিল্পীদের সঙ্গে সংগত করেছেন। এবারের আসরে দেশের সংখ্যা বেড়েছে। উইন্ড অব চেঞ্জে এখন যুক্ত আছেন বিশ্বের ২৭ দেশের যন্ত্রশিল্পী। বিশ্বখ্যাত গানের দল গান অ্যান্ড রোজেসের গিটারিস্ট রন বাম্বলফুটকে দেখা যাবে বাংলা গানের সুরে তাঁর ডাবলনেক গিটার বাজাতে। আছেন জার্মানি মার্কো মাইনম্যান, ভারতের আনন্দন শিবামনি, স্পেনের ড্যানিয়েল ক্যাসারেস, রোমানিয়ার অ্যামাডেস ইলেকট্রিক কোয়টের্ট প্রমুখ।

গানস অ্যান্ড রোজেস–এর বাম্বলফুট,বালাম,ভারতের পাপন,তন্ময় তানসেন,মাহতিম শাকিব ও আরেফিন রুমি
গানস অ্যান্ড রোজেস–এর বাম্বলফুট,বালাম,ভারতের পাপন,তন্ময় তানসেন,মাহতিম শাকিব ও আরেফিন রুমি

আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি শ্রদ্ধা

গান বাংলা চ্যানেলের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চুর সম্পর্কটা ছিল খুব চমৎকার। এই চ্যানেলের যেকোনো আয়োজনে সদর্প উপস্থিতি ছিল তাঁর। উইন্ড অব চেঞ্জ অনুষ্ঠানে তাঁর প্রভাব দর্শক-শ্রোতারা দেখেছেন। বেঁচে থাকলে এবারও হয়তো গাওয়া হতো আইয়ুব বাচ্চুর। তাই বলে উইন্ড অব চেঞ্জের মঞ্চ আইয়ুব বাচ্চু ছাড়া ভাবতে পারেননি আয়োজকেরা। আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি সম্মাননা জানিয়ে তাঁর সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় গান গেয়েছেন কৌশিক হোসেন তাপস, তন্ময় তানসেন, এলআরবির শামীমসহ কয়েকজন।

শতাধিক দেশে

দেশি–বিদেশি শিল্পী–কলাকুশলীদের মেলবন্ধনের এই অনুষ্ঠান এখন আর বাংলাদেশ কিংবা আশপাশের দেশ থেকে দর্শকেরা দেখছেন না। উইন্ড অব চেঞ্জ বিশ্বের ১১৪ দেশের দর্শক–শ্রোতারা নিয়মিতভাবে দেখছেন বলে জানান কৌশিক হোসেন তাপস।

আয়োজন নিয়ে দেশি–বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীর কথা

বাংলাদেশের অডিও এবং চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে কৈলাস খের ও পাপনের। অদিতি সিং শর্মার ঢাকায় এবারই প্রথম আসা। তাঁরা তিনজনই বাংলা গান গেয়েছেন বলে জানালেন গান বাংলা চ্যানেলের চেয়ারপারসন ফারজানা মুন্নী। তিনি এই আয়োজনের শিল্প নির্দেশক ও আলো-মঞ্চসজ্জার কাজটি করে চলছেন। যাওয়ার আগে পাপন বলেন, ‘এটা অসাধারণ একটা প্রকল্প। আমি অনেক বেশি সম্মানিত এবং গর্বিত এমন আয়োজনের অংশ হতে পেরে। শান্তির জন্য গান, উইন্ড অব চেঞ্জের এই ভাবনা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে। বিশ্বের অসাধারণ সব সংগীতশিল্পী ও কলাকুশলী নিয়ে তাপস ও মুন্নী যা করছে, তা কল্পনাতীত। আমি মনে করি, বিশ্বের মধ্যে একটা অনন্য আয়োজন।’

‘উইন্ড অব চেঞ্জ’–এর মঞ্চে ভারতের অদিতি শর্মা
‘উইন্ড অব চেঞ্জ’–এর মঞ্চে ভারতের অদিতি শর্মা

বলিউডে প্লে-ব্যাকে জনপ্রিয় একটি নাম অদিতি সিং শর্মা। এবারের আয়োজনে তিনিও যুক্ত হয়েছেন। এই আয়োজনে অংশ হওয়ার অভিজ্ঞতা অসাধারণ মনে করছেন তিনি। উইন্ড অব চেঞ্জে গাইতে পাঁচ দিন ঢাকায় ছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় এই গায়িকা। ‘বাংলাদেশের গান সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। অনেক ভালোবাসাও নিয়ে গেলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে এমন আয়োজন এককথায় চমৎকার।’ বললেন অদিতি।

প্রি–সিজনে এসেছিলেন লাটভিয়ার ড্রামার নেলি বুবইয়াঙ্কা। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি অনেক বেশি অনুপ্রাণিত। বিশেষ করে এখানকার গায়ক-গায়িকা এবং তাঁদের কণ্ঠ এত নিখাদ! বাংলাদেশের সুর ও ছন্দ আমাকে আন্দোলিত করেছে।’

পোল্যান্ডের বেহালাবাদক আলিসিয়া বলেন, ‘আমার কাছে তো বাংলাদেশ মানে সুন্দর ও রঙিন একটি দেশ। আমি এ দেশের ভালোবাসার মায়াজালে আটকে গেছি। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা লোকগানের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটা ছিল চমৎকার অভিজ্ঞতা।’

আয়োজন নিয়ে দেশের বরেণ্য গায়ক এন্ড্রু কিশোর তাঁর মুগ্ধতার কথা এভাবেই বলেছিলেন। ‘আমার রেকর্ডিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল বেলা ১১টায়। কিন্তু গাড়ি আসতে আসতে বেলা তিনটা। আমি পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন সন্ধ্যা। একধরনের মেজাজ খারাপ নিয়ে এফডিসির শুটিংয়ে ঢুকি। ভেতরে ঢুকতেই মনটা ভরে গেল। যে ক্লান্তি ছিল ভুলে গেলাম।’

‘দ্য উইন্ড অব চেঞ্জ’–এর এবারের আসরের শিল্পী ও কুশলীরা
‘দ্য উইন্ড অব চেঞ্জ’–এর এবারের আসরের শিল্পী ও কুশলীরা

এখন পর্যন্ত যাঁরা গেয়েছেন এই আয়োজনে

দেশ–বিদেশের মিউজিশিয়ানদের যৌথ প্রয়াসে খুরশীদ আলমের ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ফেরদৌস ওয়াহিদের ‘এই যে দুনিয়া’, সুবীর নন্দীর ‘পাখিরে তুই’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, বারী সিদ্দিকীর ‘রজনী’, আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’, জেমসের ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব’, এন্ড্রু কিশোরের ‘হায়রে মানুষ’, ফাহমিদা নবীর ‘আমি আকাশ হব’, সামিনা চৌধুরীর ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, কুমার বিশ্বজিতের ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, মাইলসের ‘ধিকি ধিকি’, বাপ্পা মজুমদারের ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, হাবিবের ‘রাত নির্ঘুম’, বালামের ‘লুকোচুরি’, চিরকুট ব্যান্ডের ‘জাদুর শহর’, মিলার ‘নাচো’ এবং শাহানা বাজপেয়ীর গাওয়া ‘তোমার খোলা হাওয়া’ যেন শ্রোতাদের মাধ্যমে ভিন্ন এক মাত্রা এনে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে মিনার, হৃদয় খান, ডি–রকস্টারখ্যাত শুভ, রেশমী, শামীম, ঐশীরা নিজেদের গানের পাশাপাশি লোকগান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন।

শব্দ প্রকৌশলীর কথা

শুরু থেকেই উইন্ড অব চেঞ্জ অনুষ্ঠানের সঙ্গে শব্দ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন চিরকুট ব্যান্ডের ড্রামার ও সংগীত প্রযোজক পাভেল আরিন। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে এই দলে কোক স্টুডিওতে কাজ করা কয়েকজন শব্দ প্রকৌশলী ছিলেন। অনেক কিছু শিখেছি। খুব কাছাকাছি সময়ে দেশের ও বাইরের এত এত গুণী মানুষের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমার সামনে একটা নতুন পথ খুলে গেছে। আর এখন তো উইন্ড অব চেঞ্জ অনুষ্ঠান অনেক পরিণত। এখন আরও অসাধারণভাবে আমরা মানসম্পন্ন কাজ করছি।’

আয়োজনের কারিগর

উইন্ড অব চেঞ্জ–এর এবারের আসর আগের সব কটি অনুষ্ঠানকে ছাড়িয়ে গেছে মনে করেন কৌশিক হোসেন তাপস। এবারের আসর আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ক। শিল্পী, মিউজিশিয়ান বাছাইয়ে অনেক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছেন আয়োজকেরা। আজকের দিনে পাশ্চাত্যের গানে যেমন অনায়াসে তবলা-সেতার ব্যবহৃত হচ্ছে, তেমনি পূর্ব দেশীয় সংগীতেও শোনা যাচ্ছে চেলো কিংবা তুম্বা। গান বাংলা চ্যানেলের ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’-এর মতো আয়োজন তেমনটাই মনে করিয়ে দেয়। এবারের আসরের সব গানের সংগীত পরিচালনা করেছেন তাপস। তিনি বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের বাঁশি, খোল, একতারা, দোতারা—এসব বিশ্বসংগীতকে উপহার দিচ্ছি। বিশ্বসংগীত যেন আরেকটু সমৃদ্ধ হয়, সেটাই আমি চেয়েছি। এ আয়োজন কোনোভাবে সফল হতো না, যদি আমার স্ত্রী ফারজানা মুন্নী পাশে না থাকত। এই সফলতার ৫০ শতাংশের অংশীদার তিনি। টেলিভিশনে অনুষ্ঠানটি দেখার যে সৌন্দর্য, এটা পুরো তাঁর কৃতিত্ব।’