কান দেখল 'ডিয়েগো ম্যারাডোনা'

বিশ্বকাপ হাতে ডিয়েগো ম্যারাডোনা । ফাইল ছবি
বিশ্বকাপ হাতে ডিয়েগো ম্যারাডোনা । ফাইল ছবি

তিনি এই হাসেন তো এই কাঁদেন। কখনো উত্তেজনায় শিশুদের মতো লাফঝাঁপ করেন, কখনো মেসিদের পারফরম্যান্স প্রত্যাশামতো না হলে বিরক্ত হন ভীষণ। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ধূমপানমুক্ত গ্যালারিতে তাঁকে দেখা যায় সিগারেট হাতে। তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। বাংলাদেশের বর্তমান ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার মতে, ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতো বর্ণাঢ্য চরিত্রের ক্রীড়াব্যক্তিত্ব এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় নেই!

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল হয়তো অনেকেই দেখেননি। কিন্তু মেক্সিকো বিশ্বকাপে ‘হ্যান্ড অব গড গোলে সেমিফাইনালে উঠল, সেটি দেখেননি এমন ফুটবলপ্রেমী পাওয়া যাবে না। আর যে ‘গডে’র হাত দিয়ে গোলটা হলো, তিনিই ম্যারাডোনা। ভাবছেন, ম্যারাডোনা কেন কানে?

৭২তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে গতকাল রোববার (১৯ মে) অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক আসিফ কাপাডিয়ার নতুন প্রামাণ্যচিত্র ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’র প্রদর্শনী হয়ে গেল। কানের অফিশিয়াল প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছে ছবিটি।

বর্ণিল চরিত্রের মানুষ ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’য় সেসব তুলে ধরা হয়েছে। ফাইল ছবি
বর্ণিল চরিত্রের মানুষ ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’য় সেসব তুলে ধরা হয়েছে। ফাইল ছবি

ম্যারাডোনা একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। ফুটবল সমর্থকদের একটা বড় অংশের মতে, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার। ফিফার ঘোষণায় তিনি পেলের সঙ্গে যৌথভাবে বিংশ শতাব্দীর সেরা ফুটবলার। তাঁর জীবনের চিত্রনাট্য এমনই, যার পরতে পরতে রোমাঞ্চ, বিতর্ক। এই চিত্রনাট্যে একঘেয়েমির কোনো জায়গা নেই। যে জীবন সেলুলয়েডের পর্দার জন্য ‘পারফেক্ট’!

আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের দক্ষিণ প্রান্তের একটি শান্তি টাউনের বস্তিতে দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা কিশোরের জীবন থেকে শুরু করেছেন কাপাডিয়া। প্রামাণ্যচিত্রের শেষভাগে এসে দেখা যায়, বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেই জীবন শেষ হয় ফুটবল জগতের সব থেকে বড় তারকা হয়ে। এই ছবিতে গুরুত্ব দিয়ে উঠে এসেছে ইতালীয় পেশাদার ফুটবল ক্লাব নাপোলিতে ম্যারাডোনার দিনগুলো। ওই সময়টা ম্যারাডোনা এবং নাপোলি উভয়ের জন্যই স্বর্ণযুগ ছিল। সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে নাপোলিকে ইতালীয় সুপার কাপ জিতিয়েছিলেন তিনি।

‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু একদিকে ফুটবল প্রতিভা ডালপালা মেলতে থাকে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ম্যারাডোনার কোকেন আসক্তি। তার সঙ্গে যুক্ত হয় পুত্রসন্তানের কেলেঙ্কারি। তবে যা-ই হোক, নাপোলিতে ম্যারাডোনার অর্জনকে সম্মান জানিয়ে তাঁর ১০ নম্বর জার্সিটিকে দাপ্তরিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপকে উপেক্ষা করে কি আর ম্যারাডোনার জীবন হয়। ম্যারাডোনার জীবনকে যদি কয়েকটা সেকেন্ডে বন্দী করা হয়, তাহলে বিশ্বকাপের ওই গোলটাই ম্যারাডোনা। ‘সিনা’ (২০১০) এবং অস্কারজয়ী ‘অ্যামি’র (২০১৫) পর আসিফ কাপাডিয়ার ‘ট্রিলজি’ শেষ হলো ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’ দিয়ে। আগের দুটি ছবির তুলনায় ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’ দৈর্ঘ্যে ছোট, ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট এবং টেকনিক্যালি উন্নত। কিন্তু এই ছবিতে নতুন করে কিছু উন্মোচিত হয়নি বা ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরেও অনুসন্ধান করা হয়নি। কানের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের পর আগামী ১৪ জুন যুক্তরাজ্যে ছবিটি মুক্তি পাবে।

সময়কে ধরার ক্ষেত্রে এবং বর্ণনার গুরুত্বে কাপাডিয়ার বাছাই কিছুটা অদ্ভুত। নাপোলির দিনগুলো, কোকেন আসক্তি, যৌনকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, স্থানীয় মাফিয়া গডফাদারদের সঙ্গে ম্যারাডোনার ওঠাবসা—সব বিস্তারিত এসেছে এ ছবিতে। নাপোলিতে ম্যারাডোনার যেসব নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাঁরা খুব কমই উঠে এসেছেন। সাবেক স্ত্রী ক্লদিয়া ভিল্লাফেন বা গোপন প্রেমিকা ক্রিস্টিনা সিনাগ্রে অনেকটা অতিথি চরিত্রের মতো ছিলেন। আবার ম্যারাডোনার ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের পর আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের পর কোচ বা ম্যানেজার হিসেবে আর্জেন্টিনা, দুবাই বা মেক্সিকোতে তাঁর যে জীবন, তা উপেক্ষিত এই প্রামাণ্যচিত্রে।

গ্যালারিতে এমন অদ্ভুত আচরণে প্রায়ই দেখা মেলে ম্যারাডোনার। ফাইল ছবি
গ্যালারিতে এমন অদ্ভুত আচরণে প্রায়ই দেখা মেলে ম্যারাডোনার। ফাইল ছবি

প্রামাণ্যচিত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, নাপোলিতে ম্যারাডোনার অবৈধ সন্তান ম্যারাডোনা জুনিয়রের জন্ম। তাঁকে ২০১৬ সালে এসে স্বীকার করার বিষয়ে ম্যারাডোনার অনুতপ্ত ভাব দেখা যায় এই ছবিতে। বিশেষ করে, এই বছরের মার্চ মাসেও কিউবায় জন্ম নেওয়া তিনটি সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করেছেন। এই ছবি মূলত ম্যারাডোনার সোনালি, আলোকিত জীবনের সারসংক্ষেপ। তবে এর বাইরে তাঁর জীবনের যে গভীর, রহস্যময় ও অন্ধকার দিক, তা কিছুটা উপেক্ষিত।

আসিফ কাপাডিয়ার ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’র আগের প্রামাণ্যচিত্র ‘অ্যামি’ ২০১৬ সালের অস্কারের ‘সেরা ডকুমেন্টারি ফিচার’ বিভাগে পুরস্কার জেতে। ছবিটি বিখ্যাত ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী অ্যামি ওয়াইনহাউসের বর্ণিল, বুনো জীবনের ওপর নির্মিত। মাত্র ২৭ বছরের জীবনে পেয়েছিলেন পাঁচ-পাঁচটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। ২০১১ সালের ২৩ জুলাই নর্থ লন্ডনের কেমডেনের বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ২৭ বছর বয়সী গায়িকা অ্যামি ওয়াইনহাউসকে।