কেমন চলছে ভালো সিনেমার আন্দোলন

সফল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ফসল সূর্য দীঘল বাড়ী। ছবিটি ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায়
সফল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ফসল সূর্য দীঘল বাড়ী। ছবিটি ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায়

ষাটের দশকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন শুরু হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুর্লভ বিশ্ব চলচ্চিত্রগুলো দর্শকদের দেখার সুযোগ করে দেওয়া এবং দেশে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ সৃষ্টি। বর্তমানে চলচ্চিত্র সংসদগুলোর মোর্চা সংগঠন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সঙ্গে আছে ৪০টি সংসদ। এখন কেমন চলছে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন?

নানা কারণে খুব বেশি এগোতে পারেনি এ আন্দোলন। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন বলেন, ‘নানা কারণে চলচ্চিত্র আন্দোলন থেকে সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। চলচ্চিত্রকে সংস্কৃতি হিসেবে চর্চার যে মানসিকতা, সেটা আমরা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সগুলোতে এখন তেমন লোক হয় না। ছবির প্রদর্শনীতেও নয়।’

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল সদ্য প্রয়াত মুহম্মদ খসরুর। আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ধ্রুপদি ও চলচ্চিত্রপত্রর মতো প্রকাশনা করেছিলেন তিনি। তাঁর উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। ধীরে বহে মেঘনা, সীমানা পেরিয়ের মতো ছবির নির্মাতা আলমগীর কবির এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পেছনে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ ছাড়া চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান দেওয়া শুরু হয় সংসদগুলোর দাবির প্রেক্ষিতেই। প্রথম সরকারি অনুদান পাওয়া চলচ্চিত্র সূর্য দীঘল বাড়ি বানান সংসদ আন্দোলনের কর্মী মসিহ্উদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী ছিল প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী বানিয়েছিলেন ঘুড্ডি। এরপর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে এগিয়ে নেন মানজারে হাসিন মুরাদ, মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল ও তারেক মাসুদেরা। তাঁরা বানিয়েছেন আগামী, হুলিয়া, আদম সুরত-এর মতো ছবি।

অতীতের মতো চলচ্চিত্র সংসদগুলো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন নির্মাতা মসিহ্উদ্দিন শাকের। তিনি বলেন, ‘বৈরী সময়ে আমাদের ভালো কিছু করার যে তাগিদ ছিল, নানা কিছুর ডামাডোলে এখন আর সে রকম কিছু হয়ে ওঠে না।’

একসময় ভালো ছবি সহজে পাওয়া যেত না। বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর সহায়তায় বিদেশি ভালো ছবিগুলো দেখাত সংসদগুলো। বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে ছবির দুনিয়া উন্মুক্ত। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা ও পত্রিকা প্রকাশ, কর্মশালা আয়োজন করত সংসদগুলো। এখন সেসব কার্যক্রমও খুব কম দেখা যায়।

চলচ্চিত্র সংসদগুলোর আরেকটি মোর্চা সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সভাপতি হাবিবুর রহমান খান বলেন, তাঁদের সংগঠন কেবল নামমাত্র টিকে আছে। তেমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই। কারণ চলচ্চিত্র দেখার জন্য এখন চলচ্চিত্র সংসদের আর প্রয়োজন নেই। তবে বেলায়াত হোসেন বলছেন, লাখো ছবির ভিড়ে কোন ছবিটা দেখা উচিত, সেই দিক–নির্দেশনা দিতে হয় সংসদকে। চলচ্চিত্র রুচি গঠনের জন্য দরকার চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা ও ছবি নিয়ে আলোচনা। সংসদ সেই কাজগুলো করে।

প্রতিবছর ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি। এ কাজে সারা বছর ব্যস্ত সময় পার করেন কর্মীরা। উৎসব ও চলচ্চিত্র সংসদটির প্রধান আহমেদ মুজতবা জামাল বলেন, সময় বদলেছে। চলচ্চিত্র আন্দোলনের ধরন বদলাতে হবে। সবগুলো টিভি চ্যানেলে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাংলাদেশের ধ্রুপদি চলচ্চিত্র প্রচারের নিয়ম করা দরকার।

সংসদ আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বহু বছর ধরে একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছেন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। কেন্দ্র স্থাপিত হলে চলচ্চিত্র চর্চা, নির্মাণ, প্রদর্শন ও শিক্ষায় অবদান রাখা যেত বলে মনে করেন সংসদকর্মীরা। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি লাইলুন নাহার বলেন, ‘চলচ্চিত্র কেন্দ্র স্থাপন ছাড়া এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া কষ্টকর। এ বছরও চলচ্চিত্র দিবসে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ দাবি জানিয়ে এসেছি।’

সরকারি সহায়তা খুব একটা পায় না সংসদগুলো। তবে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি, চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটি, শর্ট ফিল্ম ফোরাম ও ঢাকা ডক ল্যাব সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় অনুদান পেয়েছে। অনুদান প্রসঙ্গে বেলায়াত হোসেন বলেন, অনুদানকে একটি নিয়মের মধ্যে আনা গেলে ছোট-বড় সব সংসদ অনুদান পেতে পারে। তবে চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম বলেন, অনুদান কোনো সংসদ বা সংগঠনকে নয়, ব্যক্তিকে দেওয়া হয়। যাঁরা উৎসবের আয়োজন করেন, তাঁদের সহযোগিতা করছে সরকার।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, চলচ্চিত্রচর্চার পরিসরকে ‘সংস্কৃতি’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার কথাও বলেছেন অনেকে।