'নজরুল স্মৃতিকক্ষ' খুলছে আবার

বর্ধমান হাউসে রয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক স্মৃতি
বর্ধমান হাউসে রয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক স্মৃতি

দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতির ধারক বাংলা একাডেমির ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ অব্যবস্থাপনা আর অযত্নের শিকার। কক্ষের ভেতরে ময়লার স্তূপ। নষ্ট হওয়ার পথে বইপত্র, শিল্পীর আঁকা নজরুলের মুখচ্ছবি। স্মৃতিকক্ষ প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শকের জন্য খোলা থাকার কথা। অথচ সেটিও তালাবদ্ধ থাকে সব সময়। এই অবস্থায় একাডেমি কর্তৃপক্ষ জানাল, শিগগিরই কক্ষটি সংস্কার করে নতুন করে খুলে দেওয়া হবে।

১৯২৬ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে নজরুল অনেকবার ঢাকায় এসেছেন। নজরুলবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থে পাওয়া গেছে, বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে আছে নজরুলের অনেক দিনের স্মৃতি। মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসে তিনি প্রায় আড়াই সপ্তাহ ছিলেন। তখন প্রথম দিকে আবুল হোসেনের বাসায় উঠলেও পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের বাসা বর্ধমান হাউসে (১৯৫৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমি) ওঠেন। কয়েক মাস পর হঠাৎ করে বন্ধুদের সঙ্গে আবার আসেন। তখন তিনি হাউস বাউন্ডারির মধ্যে অবস্থিত বড় একটি পুকুরে নিয়মিত সাঁতার কাটতেন। অবসর সময় পুকুরঘাটে বসে আড্ডা দিতেন।

‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’র বর্তমান দৃশ্য। রোববার দুপুরে তোলা
‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’র বর্তমান দৃশ্য। রোববার দুপুরে তোলা

বর্ধমান হাউসে কবি কয়েকটি কালজয়ী রচনা লেখেন। বর্ধমান হাউসে কবি নজরুলের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এবং কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে। কাজী মোতাহার হোসেন দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলতুন্নেসা নামে এক নারীর সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। ফজিলতুন্নেসা ছিলেন প্রথম মুসলিম ছাত্রী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেনের দূর সম্পর্কের বোন। সেই সুবাদে তাঁর বাসায় ফজিলতুন্নেসার আসা-যাওয়া ছিল।

বর্ধমান হাউসে কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ১৯৭৮ সালের ২৯ আগস্ট বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে বাংলা একাডেমি ব্যতিক্রমী এবং ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওই দিন ছিল বর্ধমান হাউসের দোতলায় পশ্চিম দিকে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি করা হয় জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে। সেদিন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে কাজী মোতাহার হোসেন দর্শকদের মন্তব্যের খাতায় লিখেছিলেন, ‘আজ ২৯/৮/৭৮ তারিখে নজরুল স্মৃতিকক্ষ উদ্বোধন করা হলো। এটা আমার পক্ষে অতিশয় সুখের দিন; অবশ্য সে আমার নিজের গুণে নয়, নজরুল যে আমার সমসাময়িক কালের বন্ধু ছিলেন।’ আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের নজরুলবিষয়ক একক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল উদ্বোধনী দিনে।

সংস্কার করে নতুন করে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ
সংস্কার করে নতুন করে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ

ঘটা করে উদ্বোধন হলেও পরবর্তী সময় ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’টি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারেনি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। রোববার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কক্ষটি তালাবদ্ধ। সামনে পড়ে আছে নজরুলের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। একসময় খোলা হয়। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল ধুলাবালির স্তর জমেছে আসবাবপত্রে। পলেস্তারা খসে পড়েছে দেয়াল থেকে। এ কোনায় ঝুলিয়ে রাখা বীণা হাতে নজরুলের ওপর আঁকা একটি চিত্রকর্ম প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। একাডেমির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এর আগে কক্ষটি দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত হতো। বসতেন একাডেমির কর্মকর্তারা। একসময় এটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৯৭৮ সালের ২৯ আগস্ট ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’-এর উদ্বোধন করেন কাজী মোতাহার হোসেন
১৯৭৮ সালের ২৯ আগস্ট ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’-এর উদ্বোধন করেন কাজী মোতাহার হোসেন

‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’টি নতুন করে খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই একুশে বইমেলার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। এরপরই আমি কক্ষটি সংস্কার করে দর্শনার্থী এবং গবেষকদের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। যেহেতু মূল ভবনটি খুব পুরোনো, বয়সের ভারে কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। তাই খুব সাবধানে ধীরে-সুস্থে কাজ করতে হচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, একাডেমি কর্তৃক বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রণীত নজরুলের কয়েক খণ্ডের প্রামাণ্য জীবনী প্রকাশিত হবে।