যে শহর সিনেমার

কান শহরের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে বাইরে তাসমিয়াহ্‌। ছবি: সংগৃহীত
কান শহরের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে বাইরে তাসমিয়াহ্‌। ছবি: সংগৃহীত

ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে ফ্রান্সের কান শহর। চলচ্চিত্র উৎসবটিও হয় ঠিক ফ্রেঞ্চ রিভেরা বা ফ্রান্সের অপরূপ সমুদ্রতট ঘেঁষে। এই শহর বহুদিন আগে পরিচিত ছিল জেলেপল্লি এবং তাদের মাছের বাজার হিসেবে। একটা সময় হয়ে গেল ধনীদের অবকাশ যাপনের কেন্দ্র। এমনকি ‘চোরদের শহর’ হিসেবেও বদনাম ছিল কানের। খুব বেশি দিন আগে নয়, ২০১৩ সালেই কান চলচ্চিত্র উৎসবের একটি পার্টি থেকে ১৯ লাখ ইউরো মূল্যের গলার হার চুরি হয়। একই বছর ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরির ঘটনাটিও ঘটে কানে। কার্লটন হোটেলের প্রদর্শনী থেকে চুরি হয় ১০৩ মিলিয়ন ইউরোর হিরের কানের দুল ও হিরেখচিত ঘড়ি। কিন্তু সব ছাপিয়ে বিশ্বে এই শহর পরিচিত হয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসবের জন্যই।

এ বছর বসেছিল ৭২তম কান চলচ্চিত্রের আসর। মেরিল-প্রথম আলো ফেইম ফ্যাক্টরি প্রকল্পে আমার তৈরি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নায়িকার এক রাত প্রথম স্থান লাভ করে। সম্মাননা হিসেবে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ফিল্ম বাজার—মার্শে দ্যু ফিল্মে আমি যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। এ কারণে মেরিল-প্রথম আলো ফেইম ফ্যাক্টরিকে অনেক ধন্যবাদ। কান চলচ্চিত্র উৎসব সিনেমা নির্মাতাদের জন্য কেবল আরাধ্য এক সুযোগই নয়, অত্যন্ত ব্যয়বহুলও। একজন ফ্রিল্যান্স চলচ্চিত্র নির্মাতার পক্ষে এখানে অংশ নেওয়া তাই অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ, পৃষ্ঠপোষক ছাড়া প্রায় অসম্ভব। এক বেলা সাধারণ খাবারের জন্য খরচ হয়ে যায় ২০ ইউরো (প্রায় ১৮৯০ টাকা)। অনলাইনে বাসা ভাড়া নেওয়ার ওয়েবসাইট এয়ার বিএনবিতে ঢুঁ মেরে চোখ ছানাবড়া—খুব সাধারণ ফ্ল্যাটের ভাড়াও এক দিনেই দেড় শ ইউরোর (প্রায় ১৪ হাজার টাকা) একটু কম বা বেশি। যেকোনো স্যুভেনিরের দামও শুরু হয় ১০ ইউরো (প্রায় ৯৪০ টাকা) থেকে।

১৭ মে নিস কুৎ দাজোখ বিমানবন্দর হয়ে ৪০ মিনিট বাসযাত্রা শেষে কান উৎসব চত্বরে পৌঁছালাম বিকেলবেলা। ইউরোপে এ সময় সূর্য ডোবে রাত প্রায় সাড়ে ৯টায়। ফলে রাত না বলে সন্ধ্যা বলাই ভালো! পরদিন শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে ৬টা নাগাদ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্টার বন্ধ। ব্যাজ নিতে হবে পরের দিন। উৎসবে ছবি দেখা, সিনেমার এই মার্কেটে থাকা, এমনকি গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে টিকিট বুক করার সুযোগও হবে মার্শে দ্যু ফিল্মের এই ব্যাজের সুবাদে। লুমিয়ের থিয়েটারেই কানের মূল প্রতিযোগিতায় আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত সিনেমাগুলোর উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়। তারপর অন্য থিয়েটারগুলোতে দেখানো হয়। এই থিয়েটারের ক্ষেত্রে আগে থেকে অনলাইনে টিকিট বুকিং দিতে হয়। ‘গুড ব্যাজ’ ও ‘ব্যাড ব্যাজ’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। অর্থাৎ দামি ব্যাজ কিনলে আপনি সেই বুকিংটা দিতে পারবেন, টিকিট পেয়ে গেলে লুমিয়েরে সিনেমাও দেখতে পারবেন। মার্শের ব্যাজ সে অর্থে গুড ব্যাজ! কান উৎসবের করপোরেট চেহারা এখান থেকেই আমি চিনতে শুরু করলাম।

পরদিন সকাল শুরু হলো বৃষ্টি দিয়ে। ফলে আর সবার মতো ছাতা কিনেই উৎসব চত্বরে ঘুরে বেড়াতে হলো। মে মাসে জ্যাকেট পরার ঠান্ডা, যা কান শহরের জন্য একদমই মানানসই নয়।

মার্শে দ্যু ফিল্ম বা কানের সিনেমা বাজারে এসে হাজির হয় পৃথিবীর নামীদামি সব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশক আর এজেন্সি। পালে দ্য ফেস্তিভাল ভবনটি ছাড়াও তারা ছড়িয়ে থাকে বড় বড় হোটেলের টেরাসে। তারা আসে সিনেমা কিনতে ও বেচতে। আর তাদের বেশির ভাগেরই মিটিংয়ের সময় বরাদ্দ হয়ে যায় ফেস্টিভ্যালের আগেই আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের মাধ্যমে। ফলে হুট করে কেউ সিনেমার প্রস্তাবনা নিয়ে গেলেই তাদের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হবে, এমনটা নয়। এমনকি এডিটিং টেবিলে প্রায় শেষ পর্যায়ে থাকা সিনেমা নিয়েও তাদের সঙ্গে আলাপের সময় নেওয়া দুষ্কর—যদি না এর আগে অন্য কোনো চলচ্চিত্র উৎসব বা ফিল্ম বাজারে অথবা পিচিং সেশনে তাদের সঙ্গে আপনার আলাপ হয়ে থাকে। বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সিনেমাগুলোই নজর কাড়ে বেশি, তাই সেগুলোই বেচাবিক্রিও হয় বেশি।

কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রতিযোগিতায় সুযোগ পাওয়া সিনেমাগুলোর এন্ড টাইটেল দেখলেও বোঝা যায়, এদের সঙ্গে মূলত বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশক এবং এজেন্টদের যুক্ততা থাকে। যদিও প্রতিযোগিতায় দারুণ সব সিনেমা অংশ নেয়। তাদের সহযোগী হয় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে এই দিকে আমাদের সিনেমা নির্মাতাদের মনোযোগ এখন বাড়ছে। এবং সেই মনোযোগ ধরে রাখা জরুরি। মনে রাখা দরকার, তারেক মাসুদ নির্মিত ‘মাটির ময়না’সিনেমার সহযোগী প্রযোজক—বিখ্যাত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এম কে টু। যে সিনেমাটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এখন পর্যন্ত আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন বয়ে এনেছে, ২০০২ সালে ফেস্টিভ্যালের ডিরেক্টরস ফোর্ট নাইট বিভাগের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল এবং ফিপরেস্কি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস এওয়ার্ড লাভ করেছিল।

বলে রাখা ভালো, এই সময়ের বিখ্যাত ইতালিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা বার্নাদো বার্তোলুচি, হংকংয়ের নির্মাতা ওঙ্কার ওয়াই, আর্জেন্টাইন নির্মাতা গ্যাস্পার নোয়ে, মেক্সিকান নির্মাতা আলহেন্দ্রো গঞ্জালেস ইনারিতু ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগের মধ্য দিয়েই সবার সামনে হাজির হয়েছেন।

কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ৭২তম আসরের আনুষ্ঠানিক পোস্টারে বেলজিয়ামে জন্ম নেওয়া ফরাসি নবতরঙ্গের (ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাতা আনিয়েস ভাগদা উঠে এসেছেন, যিনি এ বছরের ২৯ মার্চ শারীরিকভাবে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। চকিতে মনে হলো, আমাদের কোনো নির্মাতা বা তাঁর সিনেমার কোনো দৃশ্য কবে কানের আনুষ্ঠানিক পোস্টারে হাজির হবে?

এত আয়োজনের মধ্যে যখনই বিভিন্ন দেশের সারি সারি সাদা তাঁবুর প্যাভিলিয়নের ধার ঘেঁষে নীলাভ গভীর সমুদ্রে চোখ গেছে, মনে পড়ছিল ভূমধ্যসাগরে তীব্র শীতে নোনতা পানিতে নৌকা ডুবে সদ্য হারিয়ে যাওয়া ৩৯ জন নিজ দেশি মানুষের কথা। মনে হচ্ছিল কারও জুতা, কারও জ্যাকেট কি ভেসে এসেছিল এই তীরে?

ওরা কি কখনো তীরে পৌঁছাবে? অন্তত লাশ হয়ে, স্বপ্নের ইউরোপে?

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা