ছোট ছোট ছোটগল্প

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি
>পাঠকের জন্য নির্মাতাদের ঈদ উপহার

চোখ
রেদওয়ান রনি

ঈদের আগে শেষ কার্যদিবসের কোর্ট। নুরনগরের হাসেম আলী সাক্ষীর কাঠগড়ায় সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তাকায় হাতকড়া পরা তপনের দিকে। তখন মেঝেতে পাউরুটির টুকরা বয়ে নিয়ে যাওয়া পিঁপড়াদের দেখছিল সে। একটু স্বস্তি বোধ করে হাসেম, চোখে চোখ পড়লে সাক্ষী দিতে মন খারাপ লাগত। প্রতিবার মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার সময়ই তার এমন হয়। মানুষের চোখ অদ্ভুত জিনিস, সত্য–মিথ্যার হিসাব সেখানে যেকোনো আদালতের চেয়ে কড়া।

জজকোর্টের কাছেই নছিমনের কন্ডাক্টাররা চিৎকার করতে থাকে। তপনের বাবার আক্কেলজ্ঞান দেখে হাসেমের গা জ্বলে যায়। এক গাড়িতেই কেন উঠতে হবে? তপনের বাবা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাসেমের হাতে ধরা ঈদের বাজারের দিকে। হাসেমের আবারও গা জ্বলে ওঠে, মনে হয় সাক্ষীর টাকা ছাড়া হাসেম কোনো দিনই বাজার করতে পারত না! সে সাক্ষী না দিলে মনে হয় অন্য কেউ মিথ্যা সাক্ষী দিতে পারত না! তা–ও তো সে এমনভাবে বলেছে যে ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন হচ্ছে—তোর ছাওয়ালের জীবন যে বাঁচায় দিল, তার দিকে এমন করে তাকানোর কী আছে?

হাসেম হঠাৎ ভুলে তাকিয়ে ফেলে তপনের বাবার চোখের দিক। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ে রেল বাজারে। অন্য নছিমনে যাবে সে, এই চোখ সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।

প্রতিশোধ
আদনান আল রাজীব

ছোটবেলায় আমি ঈদের শপিং করতে যেতাম বাবার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে বাসার আর কেউ যেতে চাইত না, কারণ আমি আর বাবা অনেক ঘুরে ঘুরে পছন্দ করে কিনতাম।

একবার এলিফ্যান্ট রোডের একটা জুতার দোকানে গেছি, খুব ক্লান্ত হয়ে দোকানের টুলে বসে আছি আমি। এক ভদ্রমহিলা এসে আমার কাছে তার পছন্দ করা একটি জুতার দাম জানতে চাইলেন। আমাকে টুলের ওপর বসা দেখে তিনি ভেবেছেন আমি দোকানেরই লোক।

আমার খুব রাগ হলো, সারা রাস্তা আমি ভাবতে থাকলাম—কেন তিনি আমাকে জুতার দাম জিজ্ঞেস করলেন? সেদিন বাসায় এসে প্রচণ্ড মন খারাপ করলাম, নিজেকে বারবার আয়নায় দেখলাম। আমার কি চেহারা খারাপ, জামাকাপড় কি ঠিক নেই? তিনি কেন ভাবলেন আমি জুতা বিক্রি করি?

মধ্যবিত্তের ইনসিকিউরিটি কাটেনি তখনো। এরপর ঠিক করলাম, এখন থেকে আমি সব দোকানে গিয়ে টুলেই বসব এবং বসা শুরুও করলাম। টুলে বসলেই অনেকে এসে আমাকে দোকানের লোক ভেবে দাম জিজ্ঞেস করে, আমি ইচ্ছামতো ভুলভাল দাম বলে দিই, বেচেও দিই অনেক সময়। ক্রেতা কাউন্টারের দিকে এগোনোর আগেই সটকে পড়ি। তখন একটা ভেজাল লেগে যায়, দূর থেকে দেখে আমার মজা লাগে।

একটা অদ্ভুত খেলা হয়ে গেল এটা আমার জন্য। এটা ছিল তাদের প্রতি আমার একধরনের প্রতিশোধ নেওয়ার খেলা।

অদ্ভুত ভালোবাসা
মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ

ভোরের নিস্তব্ধতায় পাখির কোলাহল। দুপুরের কড়া রোদে একটা শীতল আমেজ। গোধূলি বিকেলে স্বপ্নের মেলা। সাঁঝের আলোয় জোনাকির মিছিল। রাতের তারায় জোছনার কবিতা।

তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে সব কেমন যেন! সে পুতুলের মতো। চুলগুলো কালো মেঘদল। হরিণী চোখজোড়া। হাসি যেন ঝরনা। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে তাকে। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে রোজ পিছু নিতাম। মনের কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাত্তাই পাইনি। তবু মনমরা হইনি। বরং আরও বিপুল উৎসাহ নিয়ে তার পিছু লেগেছি। মনকে বললাম, বাপধন সাহস বাড়াতে হবে। মনের কথা শুনে অদ্ভুত দুষ্টুমি করে বসলাম। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, ওই কাণ্ডের পর মেয়েটি চিরকুটে লিখে জানিয়ে দেয় ভালোবাসার কথা। লুকিয়ে প্রজাপতির মতো দুজনে মিলে উড়ে উড়ে জীবনটাকে মনে হলো ছায়াছবির মতো। কিন্তু ধরা পড়তে হলো। মেয়েটির মা বুঝে ফেলল সব। বুকে তারকাঁটা বিদ্ধ হওয়ার অনুভূতি। গ্রাম ছেড়ে চলে গেল তারা। থেকে গেল সেই অদ্ভুত ভালোবাসা।

বহু বছর পর আবার তার সঙ্গে দেখা। সে এখনো সেই কিশোরী। তাকে অপলক দেখছি।

হঠাৎ মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম বেজে উঠল।

ছিঁড়ে গেছে
অনম বিশ্বাস

জাস্ট তিন দিনের ব্যাপার! মে মাসে ঢাকার গরম আর ট্রাফিক জ্যামের চাপে পৃথিবীর অন্য জাতির যেকোনো মানুষ পিষে যাবে। কিন্তু আমাদের কিছু হয় না বা হলেও বুঝি না। ৪৩ বছর বয়সী টাইপিস্ট মকাম মল্লিকও বোঝে না। প্রতিদিন ১২: ৩০ মিনিটে সে বাসে করে জ্যাম ঠেলে মতিঝিল পৌঁছায় ইংরেজি অফিশিয়াল চিঠি টাইপ করার জন্য। যাওয়ার পথে তারও রাগ হয় আমাদের সবার মতো, কিন্তু সে বুঝতে পারে না।

তবে আর কেউ বুঝতে না পারলেও মকাম মল্লিকের মাথার তার ঠিকই বুঝতে পারল যে এবার ছিঁড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।

গত সোমবার মকাম মল্লিকের মাথার তার ছিঁড়ে গেছে। এরপর থেকে মকাম ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে।

জাস্ট পিঁপড়ার কামড়
মিজানুর রহমান আরিয়ান

ডাক্তারের চেম্বারের সামনে অপেক্ষা করছে রায়হান, সঙ্গে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী সায়রা। সিরিয়াল নম্বর ৯। ৮ নম্বর সিরিয়ালের রোগীকে ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে দেখছেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে ফারিহা। প্রায় সাত বছর পেরিয়ে গেলেও রায়হান-ফারিহা দুজন দুজনকে চিনতে পারে। কিন্তু কথা হয় না তাদের। রায়হান স্ত্রীকে নিয়ে ঢুকে যায় ডাক্তারের চেম্বারে আর ফারিহা যায় ব্লাড টেস্ট করাতে। ফারিহার মনে পড়ে, রায়হান তাকে শেষ দিন বলেছিল, জীবনে আবার যখনই দেখা হবে, সে জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কি আমাকে মিস করো?’ কিন্তু রায়হান কিছুই বলে না। হয়তো সঙ্গে তার স্ত্রী, এ জন্য, নয়তো কথাটা ছিল শুধুই কথার কথা!

মানুষটার চেহারা ফারিহা ভুলতে বসেছে, তার সঙ্গে কাটানো সব সুন্দর মুহূর্ত ভুলে গেছে সে কবে! রায়হানের ১০১টা খারাপ ব্যবহারও ফারিহা ভুলে গেছে সময়ের সঙ্গে। ভুলতে পারেনি শুধু একটা জিনিস—রায়হানের কেয়ার, বাংলায় যাকে বলে যত্ন।

প্রচণ্ড জ্বর গায়ে ফারিহা যখন দেখে তার পাশে বসে একজন মোবাইলে ব্যস্ত, ওর মনে পড়ে কেউ একজন রাত জেগে একটু পরপর কল করে জিজ্ঞেস করত, ‘জ্বর কি একটু কমেছে?’ ফারিহার আগেভাগেই মোবাইলে কথা বলতে বলতে যখন একজন গাড়িতে বসে যায়, তখন ওর মনে পড়ে, কেউ একজন সামনে সামনে হাঁটলেও পেছন ফিরে খেয়াল রাখত কোনো রিকশা ফারিহার গায়ে লেগে যাচ্ছে না তো!

নার্স এসে দাঁড়িয়েছে ফারিহার সামনে, এখনই ব্লাড নেবে। ফারিহা প্রচণ্ড ভয় পায় এই জিনিসটা। চোখ বন্ধ করে সে। মনে পড়ে, অনেক দিন আগে এমন সময় কেউ একজন পাশে দাঁড়িয়ে হাতটা ধরে বলেছিল, ‘কিচ্ছু না, জাস্ট একটা পিঁপড়ার কামড়। তুমি চোখ বন্ধ করো।’

ফারিহা চোখ বন্ধ করেছিল, সঙ্গে সে–ও।