বাড়ির পানে মমতাজউদদীন আহমদের শেষ যাত্রা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের পক্ষ থেকে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদের মরদেহে পুষ্পস্তবক দেন নাট্যব্যক্তিত্ব অধ্যাপক রহমত আলী। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের পক্ষ থেকে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদের মরদেহে পুষ্পস্তবক দেন নাট্যব্যক্তিত্ব অধ্যাপক রহমত আলী। ছবি: প্রথম আলো

‘আমাদের ক্ষমা করবেন। অনেক দূর যেতে হবে বাবাকে নিয়ে। দোয়া করবেন।’ আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদের ছেলে তিতাস মাহমুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের অনুরোধে কথা বলছিলেন তিনি। আগের দিন তাঁর বাবা চলে গেছেন না–ফেরার দেশে। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাঁকে দাফন করা হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে, ভোলাহাটে বাবার কবরের পাশে।

আজ সোমবার সকালে ১০টায় যখন মমতাজউদদীন আহমদের নিথর দেহ বহনকারী গাড়িটি সাইরেন বাজাতে বাজাতে এসে থামল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে, তখন আকাশ ছিল মেঘলা। প্রিয় মানুষটির মুখটি শেষবারের মতো দেখতে, শ্রদ্ধা জানাতে আগেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন অনেকে। সমাজের বিশিষ্টজনেরা এলেন, অংশ নিলেন জানাজায়। তাঁদের দোয়াকে সঙ্গী করেই পরিবারের সদস্যরা মমতাজউদদীন আহমদের মরদেহ নিয়ে যাত্রা করেন গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। বেলা সোয়া একটায় শবযাত্রা যমুনা সেতুর কাছাকাছি এলাকায় ছিল।

গতকাল রোববার বেলা ৩টা ৪৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন মমতাজউদদীন আহমদ। ওই দিন রাতে মিরপুর রূপনগরে তাঁর বাসভবনসংলগ্ন মদিনা মসজিদে বাদ এশা প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরদেহ ফ্রিজিং ভ্যানে তাঁর বাসভবনের সামনে রাখা হয়। সেখানে থেকেই আজ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক মমতাজ উদদীন আহমদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
অধ্যাপক মমতাজ উদদীন আহমদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল প্রমুখ। শ্রদ্ধা জানাতে ও জানাজায় এসেছিলেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, ম হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ও সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ সামাদ, প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক, নাট্যকার অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী, উদীচীর সহসভাপতি শংকর সাঁওজাল, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, রহমত আলী, অভিনেতা কে এস ফিরোজ, খায়রুল আলম সবুজ, সালাউদ্দিন লাভলু, বাচিকশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

জানাজা শেষে পরিবারের পক্ষে উপস্থিত সবার উদ্দেশে মমতাজউদদীন আহমদের ছেলে তিতাস মাহমুদ বলেন, ‘যে সম্মান, গৌরব, অহংকার বাবাকে আপনারা দিয়েছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাদের দোয়ায় আমার বাবা শ্রেষ্ঠতম স্থানে যাবেন। আমার বাবা সফল, বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য জীবন পেয়েছেন, যা দিয়েছেন আপনারা।’

এ সময় তিতাস মাহমুদ জানান, বাবার নামে একটি পুরস্কারের প্রবর্তন করবেন তাঁরা। প্রতিবছর মমতাজউদদীন আহমদের জন্মদিনে একজন নাট্যকর্মীকে এ পুরস্কার দেওয়া হবে। আগামী জন্মদিনে (১৮ জানুয়ারি ২০২০) প্রথমবারের মতো এ পুরস্কার দেওয়া হবে।

জানাজা শেষে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘মমতাজউদদীন আহমদ ছিলেন দেশের নাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ। মঞ্চনাটক রচনায় তিনি অন্যতম পথপ্রদর্শক। মঞ্চনাটক রচনায় যে পথ তিনি দেখিয়েছেন, তা দেশের নাট্যাঙ্গন অনুসরণ করবে, অনুকরণ করবে।’

দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। তাঁর পরিবারের পক্ষে ভাগনে শাহরিয়ার মাহমুদ জানান, ২৬ এপ্রিল অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ১২ মে আবার বাসায় নেওয়া হয়। পরে আবার ১৬ মে থেকে অ্যাপোলো হাসপাতালে নেওয়া হয়। বেশির ভাগ সময়ই তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন।

১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মমতাজউদদীন আহমদ। তা*র বাবা কলিমুদ্দিন আহমদ ও মা সখিনা বেগম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালে গোলাম আরিফ টিপুর সঙ্গে তিনি রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। সেই সময় রাজশাহী কলেজে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণেও ভূমিকা রাখেন। রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে চারবার কারাবরণ করেন।

মমতাজউদদীন আহমদ ৩২ বছরের বেশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় নাট্যকলায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ১৯৭৬-৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭-৮০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

মমতাজউদদীন আহমদ শিক্ষক ও লেখক হিসেবে পরিচিতি পেলেও মঞ্চনাটকের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সংস্কৃতি অঙ্গনের কর্মী হিসেবে সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। তাঁর লেখা নাটক ‘কি চাহ শঙ্খ চিল’ ও ‘রাজা অনুস্বরের পালা’ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তালিকাভুক্ত।

মমতাজউদদীন আহমদের লেখা জনপ্রিয় নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বিবাহ’, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘বর্ণচোরা’, ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’, ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’, ‘রাজা অনুস্বরের পালা’, ‘বকুলপুরের স্বাধীনতা’, ‘সুখী মানুষ’, ‘রাজার পালা’, ‘সেয়ানে সেয়ানে’, ‘কেস’, ‘ভোটরঙ্গ’, ‘উল্টো পুরান’, ‘ভেবে দেখা’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তাঁর বেশ কিছু নাটক বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

শতাধিক বই লিখেছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত’, ‘বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত’, ‘প্রসঙ্গ বাংলাদেশ’, ‘প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু’, ‘আমার ভেতরে আমি’, ‘জগতের যত মহাকাব্য’, ‘মহানামা কাব্যের গদ্য রূপ’, ‘সাহসী অথচ সাহস্য’, ‘নেকাবী এবং অন্যগণ’, ‘সজল তোমার ঠিকানা’, ‘এক যে জোড়া, এক যে মধুমতি’, ‘অন্ধকার নয় আলোর দিকে’। সর্বশেষ ১ জুন বিশ্বসাহিত্য ভবন থেকে প্রকাশ পায় তাঁর সর্বশেষ বই—‘আমার প্রিয় শেক্‌সপিয়ার’।

১৯৯৭ সালে নাট্যকার হিসেবে একুশে পদকে ভূষিত হন মমতাজউদদীন আহমদ। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি বিশেষ সম্মাননা, শিশু একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, আলাউল সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশের বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।