মানসীর রিয়াল স্টলে দোকানের সারি

ভবন আছে, কিন্তু মানসী সিনেমা হলের কার্যক্রম নেই। ছবি: মাসুম আলী
ভবন আছে, কিন্তু মানসী সিনেমা হলের কার্যক্রম নেই। ছবি: মাসুম আলী

বছরখানেক আগে যেখানে ছিল শত শত দর্শকের আসন, সেখানে এখন সারি সারি দোকান। বিক্রি হচ্ছে ইলেকট্রিক পণ্য আর যানবাহনের যন্ত্রাংশ। যে যন্ত্র দিয়ে আলো পড়ত পর্দায়, সেটি পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে। মানসী সিনেমা হলে এবার ঈদে কোনো ছবি মুক্তি পায়নি। নেই কোনো পুরোনো ছবির প্রদর্শনী। এবার ঈদে সেখানে আলো জ্বলেনি। দেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম দিকের সিনেমা হলগুলোর মধ্যে অন্যতম এই প্রতিষ্ঠানের মূল সুরম্য মিলনায়তনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। খুলে ফেলা হয়েছে শত বছরের পুরোনো কারুকাজের বিশাল ফটকটি। কর্তৃপক্ষ বলছে, ছোট পরিসরে নতুন করে চালু হবে মানসী। তবে কবে চালু হবে, তা সুনির্দিষ্ট নয়।

পুরান ঢাকার ১ নম্বর বংশাল রোডে অবস্থিত মানসী হল ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলসহ নানা সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে। যুগের পর যুগ প্রতিষ্ঠানটি পুরান ঢাকার চলচ্চিত্রানুরাগী দর্শকদের চাহিদা পূরণ করেছে। প্রতিবছর ঈদে এখানে রমরমা ব্যবসা হতো। একসময় এখানে উর্দু ও হিন্দি ছবির প্রদর্শনী হতো। পরে ইংরেজি আর বাংলা ছবির প্রদর্শনী হয় এখানে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে বংশাল রোডে মানসী হলে গিয়ে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসন আমলে নির্মিত ভবনটির নিচতলার মূল প্রবেশ পথ দিয়ে হলে ঢোকার নকশা করা কাঠের দরজাটি নেই। ভেঙে ফেলা হয়েছে মুখোমুখি দুটি টিকিট কাউন্টার। পুরোনো সাইনবোর্ড আছে, তবে তার একটা অংশ ঢাকা পড়েছে দোকানের সাইনবোর্ডে। মূল প্রেক্ষাগৃহের ভেতরে আগের কোনো চিহ্ন নেই, যা একসময় শত শত দর্শকের পদচারণে মুখরিত হতো, এখন সেখানে সারি সারি ঘর বানানো হয়েছে। ছোট-বড় দোকানে আলো জ্বলছে।

দর্শক বসার জায়গায় এখন দোকানের সারি। ছবি: মাসুম আলী
দর্শক বসার জায়গায় এখন দোকানের সারি। ছবি: মাসুম আলী

যেখানে আগে পর্দা ছিল, সেখানে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি বানানো হয়েছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখা যায় নতুন একটি অফিস কক্ষ হয়েছে। ঘরের একপাশে হলের প্রক্ষেপণযন্ত্রগুলোর অসহায় অবস্থান। টেবিলের সামনে রাখা হয়েছে হলের দর্শক সারিতে ব্যবহৃত তিনটি চেয়ার। এখানে দেখা হয় পরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তিনি ‘দ্য নিউ পিকচার্স লিমিটেড’-এর পক্ষে এখন হলটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি জানান, ১০ বছরের বেশি সময় লোকসান দিয়েই মালিকপক্ষ হলটি চালিয়েছে। গাজীপুরের জমিদার আবরার সিদ্দিকীর বংশধর চৌধুরী আফসার আহমেদ সিদ্দিকী ও মুনিরা সিদ্দিকী হল পরিচালনায় আন্তরিক ছিলেন। তাঁরা বলেছেন, ব্যবসা নয়, শুধু ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে যত দিন পারা যায় হলটি চালিয়ে যাবেন। কিন্তু অবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের বেতন দেওয়া দূরে থাক, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে যায়। একটা সময় প্রতি প্রদর্শনীতে দর্শকের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতেন মানসী হলের কর্মীরা, সেখানে গত কয়েক বছরে শুধু শুক্রবারের বিকেল আর সন্ধ্যার প্রদর্শনীতে ভিড় দেখা যেত। তাই মালিকেরা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন, নতুন উদ্যোগে নিচে মার্কেট করে ওপরে ছোট পরিসরে সিনেপ্লেক্স আকারে হলটি চালু করবেন। এখন নিচতলায় মার্কেট হয়েছে। ওপরের ডিসি এবং দর্শকের বসার ঘর ভেঙে দোকান বানানো হচ্ছে।

মানসীর পুরোনো সিঁড়ি এবং মিলনায়তনে ঢোকার প্রবেশ পথ। ফাইল ছবি
মানসীর পুরোনো সিঁড়ি এবং মিলনায়তনে ঢোকার প্রবেশ পথ। ফাইল ছবি

যেখানে ড্রেস সার্কেল বা ডিসি অংশ ছিল, সেখানে দেখা যায় নির্মাণসামগ্রী পড়ে আছে। কয়েকটি পুরোনো চেয়ারও দেখা যায়। এখানেই ছোট পরিসরে হল বানানো হবে। আগে মানসী হলে দুটি তলায় ৭৫৫টি আসন ছিল। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, শুধু একটি তলাতেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মানসী সিনেপ্লেক্স পরিচালিত হবে। তাতে ২০০ আসন থাকবে। কবে চালু হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি নির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা বলতে পারলেন না।

জানা গেছে, এর আগে আরও দুবার দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়েছিল মানসী হল। মুক্তিযুদ্ধের আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মুসলমানরা মানসী নামের কারণে হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান ভেবে এতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে প্রতিষ্ঠানটি। অনেক পর প্রতিষ্ঠানটি নাম পরিবর্তন করে ‘নিশাত’ নামে চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরে নিশাতকে পাকিস্তানিদের সম্পত্তি ভেবে আবার আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বন্ধ হয় সিনেমা হলটি। কিছুদিন পর আবার মানসী নামে ফিরে আসে প্রেক্ষাগৃহটি। তবে এখনো প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন স্থানে নিশাত নামটি আছে।

পড়ে আছে আলো প্রক্ষেপণের যন্ত্রগুলো। ছবি: মাসুম আলী
পড়ে আছে আলো প্রক্ষেপণের যন্ত্রগুলো। ছবি: মাসুম আলী

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ঐতিহ্যবাহী বলিয়াদী জমিদার আবরার আহমেদ সিদ্দিকী ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র সমিতি এবং ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গ চলচ্চিত্র সমিতির অন্যতম নেতা ছিলেন। এর আগে তিনি ১৯২৬ সালে বংশাল এলাকায় একটি হল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ওই সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য জমিদার আবরার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যান। কবিগুরু তখন সিনেমা হলের নাম দেন মানসী।