বাজেটের ১ শতাংশ হোক সংস্কৃতির

যথাযথ প্রণোদনা পেলে পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রগুলো হয়ে উঠবে আরও প্রসারিত। বরাদ্দ বাড়লে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো হবে উন্নত। নৃত্যাঞ্চলের একটি পরিবেশনা। ফাইল ছবি
যথাযথ প্রণোদনা পেলে পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রগুলো হয়ে উঠবে আরও প্রসারিত। বরাদ্দ বাড়লে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো হবে উন্নত। নৃত্যাঞ্চলের একটি পরিবেশনা। ফাইল ছবি

১৩ জুন ঘোষিত হবে ২০১৯–২০ অর্থবছরের বাজেট। আসন্ন বাজেটে সংস্কৃতিখাতের বরাদ্দ নিয়ে চিন্তিত এই অঙ্গনের মানুষেরা। তাঁদের অনেক দিনের দাবি, মোট বাজেটের ন্যূনতম ১ শতাংশ বরাদ্দ যেন সংস্কৃতির জন্য রাখা হয়। কেউ বলছেন, সেটি ২ শতাংশ হলে আরও ভালো হয়।

কয়েক বছর ধরে সংস্কৃতির বাজেট অল্প অল্প করে বাড়ানো হচ্ছে। সেটি অন্য খাতগুলোর তুলনায় খুবই কম। নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন বলে আসছি, দেশের মোট বাজেটের ১ শতাংশ যেন সংস্কৃতির জন্য রাখা হয়। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রুখতে যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হয়, তাহলে প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী সংস্কৃতিচর্চার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য সংস্কৃতি খাতের বাজেটটি একটু বড় হওয়া দরকার।’

সংস্কৃতির কোন কোন ক্ষেত্রে বাজেট দরকার? রামেন্দু মজুমদার বললেন, ‘একদিকে উপজেলা পর্যায়ে অবকাঠামেরা তৈরি করতে হবে। আমি মনে করি, দেশের প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি করে মুক্তমঞ্চ থাকবে, যেখানে নিয়মিত নাটক, গান, নৃত্য ও আবৃত্তিচর্চা চলবে। প্রতিটি উপজেলায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মতো একটি জায়গা থাকবে, যেখানে সংস্কৃতিকর্মীরা মিলিত হবেন। শুধু তা–ই নয়, এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ব্যবহার যেন সহজলভ্য হয়, সেই দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ মনে করেন, সংস্কৃতিই একটি জাতির পরিচয়। তাই বাজেটে সংস্কৃতির ব্যাপারটি অধিকতর গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, সংস্কৃতি খাতেই সবচেয়ে কম বরাদ্দ হচ্ছে। জাতীয় বাজেটের মাত্র দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, যা সংস্কৃতির বাজেট হিসেবে অতি নগণ্য। আমি মনে করি, জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ১ শতাংশ দেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা উচিত।’

তিনি মনে করেন, তৃণমূল পর্যায় থেকে সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। ক্লাবগুলোকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো এসবের ফল পাওয়া যাবে না, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ লাভবান হবেই। তিনি বলেন, ‘ভাবতে অবাক লাগে, এই ঢাকা শহরে উত্তরা, বারিধারা, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় কোনো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই! তাহলে সংস্কৃতি বাঁচবে কীভাবে? অথচ এসব জায়গায় খাবারের দোকান আর মার্কেটের অভাব নেই। ঢাকা এখন খাবার ও মার্কেটের শহরে পরিণত হয়েছে।’

অক্সিজেন যেভাবে মানুষকে ঘিরে রাখে, কিন্তু দেখা যায় না, সংস্কৃতিও তেমন, বললেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। তাঁর মতে, জাতীয় বাজেটের ২ শতাংশ সংস্কৃতি খাতের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আছে ঠিকই, কিন্তু এর কর্মপরিধি সংকুচিত। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি ও বাংলা একাডেমির মূল কাজ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা। সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্ক শিল্পকলা একাডেমির। জেলা ছাড়াও এখন উপজেলায় এটি বিস্তৃত হচ্ছে। অনুষ্ঠান আয়োজন ও কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির অন্য কোনো কাজ নেই। কিন্তু শিল্পকলা বা অন্য একাডেমিগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে শিল্প-সাহিত্যকে উৎসাহিত করা, নিজেদের অনুষ্ঠান করা নয়।’

মানুষকে প্রতারণা, দুর্নীতি থেকে দূরে রাখা এবং নীতিবান করে তোলার জন্য সংস্কৃতি বড় ভূমিকা রাখে। এ প্রসঙ্গে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। মানুষ সাহিত্য পড়বে, গান শুনবে, ভালো চিত্রকলা দেখবে, মহৎ মানুষকে অনুসরণ করবে, ভালো নাটক ও চলচ্চিত্র দেখে আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নেবে। তাই যেকোনো উন্নত দেশে ভালো শিল্পকর্মকে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। ভারত উচ্চাঙ্গসংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক, চারুশিল্প, কুটিরশিল্প, ভাস্কর্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থ সহায়তা দেয়। রাষ্ট্র জানে শিল্পের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত কর্মীদের চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। তাই তাঁদের মাসিক বেতন দিয়ে থাকে। বাংলাদেশেও আমরা সেটা চালুর চেষ্টা করে আসছি। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি থাকা সত্ত্বেও, সেটা কার্যকর হচ্ছে না।’

প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, ‘বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর সবখানেই নিজের মতো করেই পরিচিত হচ্ছে, এটা ভালো। তবে আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে আরো বেগমান করার জন্য বাজেটে সংস্কৃতির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। সারা দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আরও প্রসারিত করার জন্যই এটা প্রয়োজন।’

শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘শিল্পকলা একাডেমি এখন উপজেলা পর্যায়ে। সেগুলোর কাজ শেষ করা দরকার। তা ছাড়া শচীন দেববর্মন থেকে সৈয়দ শামসুল হক পর্যন্ত ১৫ জন ব্যক্তিত্বের নামে আমরা ইনস্টিটিউট করছি। এসবের জন্য যথেষ্ট অর্থ দরকার। জাতীয় মান নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উপস্থাপন করতে হবে। এ কাজগুলো করতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।’