সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ, পেছনে নাটকের টিকিট বিক্রি

টিকিট কাউন্টারের সামনে চলছে প্রতিবাদ সমাবেশ। ছবি: মাসুম আলী
টিকিট কাউন্টারের সামনে চলছে প্রতিবাদ সমাবেশ। ছবি: মাসুম আলী

আগের রাতে প্রতিবাদ মিছিলের পর বুধবার বিকেলে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন স্তালিন নাটকের দর্শকের একটি অংশ। বিকেল থেকেই নাট্যকর্মীদের পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করেন ‘স্তালিন’ নাটকের বিরোধিতাকারীরা। যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে যেখানে হাজির হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। পুলিশি পাহারার মধ্য দিয়েই বিকেল পাঁচটার কিছু পরে প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়। প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে সন্ধ্যা সাতটায় অনুষ্ঠিত হয় ‘স্তালিন’ নাটকের তৃতীয় প্রদর্শনী। সেখানে বিপুল দর্শকের উপস্থিতি ছিল।

সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার-সিএটি’র নতুন মঞ্চনাটক ‘স্তালিন’। গত সোমবার সন্ধ্যায় নাটকটির উদ্বোধন হয় ঢাকার মঞ্চে। এ নাটকে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনেছেন দর্শকের একটি অংশ। মঙ্গলবার রাতে নাটক শেষে তাঁরা প্রতিবাদ জানান।

বুধবার প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী বজলুর রশীদ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হাকিম লালা, বাসদ মার্কসবাদী কেন্দ্রীয় নেতা মানস নন্দী, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতা রাজিকুজ্জামান রতন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা হামিদুল হক, বিবর্তন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মফিজুর রহমান লালটু, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু, নারী মুক্তি ফোরামের শিমা দত্ত প্রমুখ।

তারা বলেন, ‘যখন কোনো নাটক ইতিহাস বিকৃতি করে তখন সেটা কোনো সংস্কৃতির ভেতর থাকে না। সেটা হয়ে যায় অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতির এক প্রতিফলন আমরা এই নাটকে দেখছি। আমরা বরাবর অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি। আমাদের আজকের অবস্থানও সেই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অংশ।’

স্তালিন নাটকের একটি দৃশ্য।
স্তালিন নাটকের একটি দৃশ্য।

তারা আরও বলেন, ‘আমরা কেউ নাটকের বিপক্ষে না। কোনো একটা নতুন নাটক আসলে আমরা সদলবলে আসি নাটক দেখার জন্যে। আমরা কখনোই শিল্প সংস্কৃতির বিপক্ষে না। কোনো একটা নাটক কখনোই বন্ধের পক্ষে না। আমরা মনে করি এই নাটক বন্ধ করা হোক বা না হোক, সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই। এখানে যারা নাট্যকর্মী নাট্যজন আছেন, নাট্যব্যক্তিত্ব তারাই ঠিক করবেন কোনো নাটক চলবে বা চলবে না। কিন্তু আমরা মনেকরি একটা নাটকে ইতিহাস বিকৃতি করার অধিকার করো নেই।’

বক্তাদের মতে, নাটকের সংলাপ যেন তৈরি করাই হয়েছে স্তালিনকে বিশ্বের একজন নিকৃষ্ট রাজনৈতিক ভিলেন হিসেবে উপস্থাপনের আকাঙ্ক্ষায়। কেবল স্তালিন নয় গোটা মার্ক্সিজম, কমিউনিজম, লেনিন, মাও সে তুং সকল ব্যক্তি, তত্ত্বের বিরুদ্ধেই এই নাটক। স্তালিন সম্পর্কে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা এর প্রধান উপজীব্য। এ সময় বক্তারা নাটকের নির্দেশক কামালউদ্দিন নীলুকে সেখানে এসে নিজের বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান।

প্রতিবাদ সমাবেশটি হয় জাতীয় নাট্যশালার নাটকের টিকিট কাউন্টারের সামনে। সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ, পেছনেই চলে টিকিট বিক্রি। টিকিট কিনতে আসা দর্শকদের সমস্যা হয়। এ পরিস্থিতিতে শিল্পকলা একাডেমির কয়েকজন কর্মকর্তা সমাবেশের বক্তাদের অনুরোধ করলে তারা কিছু সামনে এসে জায়গা করে দেন দর্শকদের। টিকিট বিক্রি চলে নির্বিঘ্নে। নির্ধারিত সময়ে শুরু হয় নাটক। বুধবার ছিল নাটকের শেষ প্রদর্শনী।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে জাতীয় নাট্যশালায় নাটকটির দ্বিতীয় প্রদর্শনী শেষে শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশ বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। নাটক শেষে একযোগে প্রতিবাদ করে উঠার সঙ্গে স্লোগানও দেন তারা। তাদের বক্তব্য, নাটকে যোসেফ স্তালিনকে ভয়ংকর, অমানবিক, একরোখা ও নির্দয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। তারা এ সময় ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘পশ্চিমা দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’ ‘সমাজতন্ত্রবিরোধী নাটক চলবে না’, সহ নানা রকম স্লোগান দিতে থাকেন। অন্তত ১৫ মিনিট পর্যন্ত চিৎকার ও স্লোগান চলে মিলনায়তনে এবং নাট্যশালার করিডরে। একপর্যায়ে থিয়েটার অঙ্গনের জ্যেষ্ঠ কর্মীর হস্তক্ষেপে তা থামে।

এসব সমালোচনাকে ‘থিয়েটার শক্তি’ বলে মন্তব্য করে নাটকের নির্দেশক কামালউদ্দিন নীলু। গতকাল রাতের ঘটনার পর নাটকের নির্দেশক কামালউদ্দিন নীলুর সঙ্গে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমি মনে করি, এটাই থিয়েটারে শক্তি, একটা শিল্প কতটা শক্তিশালী হলে এটা সম্ভব! আমি মনে করি, এটা নিয়ে এভাবে প্রতিবাদ না করে আলোচনা-বিতর্ক হতে পারত।’ তাঁর দাবি, নাটকের কোনো কিছুই বানানো বা তাঁর নিজের কল্পনাপ্রসূত না। নাটকটির পাণ্ডুলিপি তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সাইমন সিব্যাগ মন্টিফিওরের ‘স্তালিন: দ্য কোর্ট অব দ্য রেড জার’, স্ভেৎলানা অ্যালিলুয়েভার ‘অনলি ওয়ান ইয়ার’ ও ‘টোয়েন্টি লেটার্স টু আ ফ্রেন্ড’, ডেভিড পিনারের ‘দ্য টেডি বিয়ার্স পিকনিক’ এবং রোজমেরি সুলিভানের ‘স্তালিন্স ডটার’ থেকে।