নাট্যকার হয়েই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন গিরিশ

গিরিশ কারনাড (১৯ মে ১৯৩৮—১০ জুন ২০১৯)
গিরিশ কারনাড (১৯ মে ১৯৩৮—১০ জুন ২০১৯)

ঢাকার মঞ্চে আলোচিত তুঘলক দেখেছেন অনেকেই। গিরিশ কারনাডের বয়স মাত্র ২৬ বছর, তখন লিখেছিলেন নাটকটি। ১৯৬৪ সালে লেখা রূপকধর্মী এই নাটকের মাধ্যমে তিনি নেহরুর সময়ের রাজনীতির সমালোচনা করেন। এই নাটকটিই গিরিশ কারনাডকে ভারতসহ সারা উপমহাদেশে খ্যাতি এনে দেয়। তাঁর প্রথম লেখা নাটক যযাতিও ঢাকায় মঞ্চে দেখা গেছে।

সেই নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা গিরিশ কারনাড ৮১ বছর বয়সে শেষবার নিশ্বাস ছাড়লেন সোমবার ১০ জুন ভারতের বেঙ্গালুরুর বাসভবনে। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী মানুষটি শেষ জীবনে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। দুর্বল হয়ে পড়েছিল ফুসফুস। শেষ দিনগুলোতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ নিষ্ক্রিয় হতে থাকে।

মোটা দাগে আমাদের দেশের দর্শকেরা ভারতের গিরিশ কারনাডকে শেষবার সক্রিয় দেখেন বলিউডের ব্যবসাসফল টাইগার জিন্দা হ্যায় ছবিতে। এই তো কয়েক মাস আগে ভারতে একটি প্রতিবাদ সভায় নাকে পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন গিরিশ। ‘মি টু আর্বান নকশাল’ বা ‘আমিও শহুরে নকশাল’ বলে গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়েছিলেন। ভারতের লোকসভা ভোটের আগে প্রায় ৬০০ থিয়েটার কর্মীর সঙ্গে একযোগে বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। ভারতের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, কর্নাটক সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য করতে চেয়েছিল। কারনাড পরিবার রাজি হয়নি। রাজসম্মান নয়, নাট্যকার হিসেবেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন গিরিশ। তবে সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করেনি স্থানীয় সরকার। প্রয়াত শিল্পীর সম্মানার্থে কর্নাটকে তিন দিন শোকদিবস ও এক দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়।

সাধারণ থেকে অসাধারণ গিরিশ কারনাড

প্রাতিষ্ঠানিক নাম গিরিশ রঘুনাথ কারনাড। ১৯৩৮ সালের ১৯ মে মহারাষ্ট্রের মাথেরনে জন্ম। লেখাপড়ায় খুব উজ্জ্বল ছিলেন। ‘রডস স্কলারশিপ’ নিয়ে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে পড়তে যাওয়ার আগেই লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম নাটক যযাতি।তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩। গণিত এবং পরিসংখ্যানে স্নাতক করার পর ইংল্যান্ডে দর্শন, সমাজনীতি এবং অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন। দেশে ফিরে তৎকালীন মাদ্রাজের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে টানা সাত বছর কাজ করেছেন। তবে মন পড়ে ছিল নাটকে। চাকরি ছেড়ে স্থানীয় নাটক দলে যোগ দেন। তাঁর লেখা অন্যান্য নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তুঘলক, নাগমন্ডল, হয়বদন, অগ্নি মাট্টু মালে বা অগ্নি ও বর্ষা, তালেদণ্ড বা শিরশ্ছেদ, হিট্টিনা হুঞ্জা বা বলি।২০১৮ সালে গিরিশ কারনাডের শেষ নাটক রাক্ষস টঙ্গোদি প্রকাশ পায়।

পর্দার ভেতরে–বাইরে গিরিশ

কারনাডের নিজের পরিচালনায় শেষ ছবি আপনা দেশ, যা আগামী আগস্ট মাসে মুক্তি পাওয়ার কথা। শুরুটা হয়েছিল ১৯৭১ সালে বংশবৃক্ষ পরিচালনার মধ্য দিয়ে। এ ছবির জন্য সেরা পরিচালক হিসেবে ভারতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান তিনি। প্রায় শ খানেক সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন কারনাড। তার মধ্যে আছে নিশান্ত, মন্থন, স্বামী, ইকবাল। প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের আত্মজীবনীর অডিওবুক উইংস অব ফায়ার–এ কণ্ঠ দিয়েছিলেন গিরিশ। নাটক এবং সাহিত্যের জন্য ভারতে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, কালিদাস সম্মান, রাজ্যোৎসব পুরস্কার এবং যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার পেয়েছিলেন গিরিশ। পরিচালনা এবং চিত্রনাট্যের জন্য ১০ বার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাংলাদেশে গিরিশ কারনাডের বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। তারিক আনাম খানের নির্দেশনায় তুঘলক, তৌকীর আহমেদের নির্দেশনায় হয়বদন মঞ্চে এনেছিল নাট্যকেন্দ্র। যযাতি নাটকটি মঞ্চে এনেছিল সময় নাট্যদল এবং আশীষ খন্দকারের নির্দেশনায় অগ্নিজল মঞ্চে এনেছিল নাট্যধারা। ২০১২ সালের দিকে প্রাচ্যনাট স্কুলের প্রযোজনায় শাহেদ আলীর নির্দেশনায় তুঘলক নাটকটি আবার মঞ্চে আসে। ঢাকার বাইরে রংপুরের সারথি নাট্যসম্প্রদায় থেকে আশরাফী মিঠুর নির্দেশনায় হয়বদন মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৯৫ সালে।

স্মৃতিচারণা করে তারিক আনাম খান বলেন, ‘১৯৭৬ সালে এনএসডিতে পড়ার সময় গিরিশ কারনাডের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। পরে ৮৬ সালে কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের অডিটরিয়ামে বসে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম। তাঁর নাটক আমাকে ভীষণ প্রভাবিত করেছে। তাঁর সাহসিকতাও আমাকে প্রভাবিত করেছে।’