কলকাতায় 'দেবতার গ্রাসে' সৌমিত্র-নাসিরউদ্দিন-পার্থপ্রতিম

শুটিংয়ের অবসরে আদালত চত্বরে সৌমিত্র, নাসিরউদ্দিন ও পার্থপ্রতিম। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
শুটিংয়ের অবসরে আদালত চত্বরে সৌমিত্র, নাসিরউদ্দিন ও পার্থপ্রতিম। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

তিনজনেই প্রখ্যাত শিল্পী। দুজন নামী অভিনেতা। নিজ দেশ ও দেশের বাইরের মাটিতেও ছড়িয়ে রয়েছে এই শিল্পীদ্বয়ের সুনাম, কৃতী। কিন্তু কখনো এই নামী দুই শিল্পী একসঙ্গে ছবি করেননি। দুজনেরই ইচ্ছে ছিল একসঙ্গে একটি ছবিতে অভিনয় করার। সেই ইচ্ছাই পূরণ হলো এবার। একসঙ্গে শুটিং করলেন দুজন। আর এতে দারুণ অভিভূত দুজনই। এই দুই কিংবদন্তি শিল্পী হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নাসিরউদ্দিন শাহ। আর এই দুই শিল্পীর সঙ্গে যোগ দিলেন আরও এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী, বাংলাদেশের মূকাভিনেতা পার্থপ্রতিম মজুমদার।

পার্থপ্রতিম বাংলাদেশের সন্তান। জন্ম বাংলাদেশে। জীবনের উত্থান বাংলাদেশ থেকেই। ৩৮ বছর ধরে থাকছেন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। তাঁর মূকাভিনয় গোটা ইউরোপ-আমেরিকায় সুনাম ছড়িয়েছে। ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সেরা সম্মান নাইট উপাধিও পেয়েছেন তিনি। মূকাভিনয়ের পাশাপাশি তিনি মঞ্চেও অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রেও পা রেখেছেন। তাঁরও ডাক পড়েছে কলকাতার দেবতার গ্রাস ছবিতে। সেই ডাক পেয়ে পার্থপ্রতিম ছুটে এসেছেন কলকাতায়। শুটিং করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নাসিরউদ্দিন শাহের সঙ্গে। তারপর গত মাসের শেষ সপ্তাহে কাজ শেষ করে ফিরেও গেছেন প্যারিসে।

দেবতার গ্রাস ছবিটি পরিচালনা করছেন কলকাতার নামী পরিচালক শৈবাল মিত্র। এর আগে তিনি শজারুর কাঁটা, সংশয় এবং চিত্রকর ছবি পরিচালনা করে প্রশংসিত হয়েছেন। এবার তিনি হাত দিয়েছেন একটি বিদেশি গল্পে। বিখ্যাত আমেরিকান নাটক ইনহেরিট দ্য উইন্ড অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে দেবতার গ্রাস। সাম্প্রদায়িকতা, অসহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতিবাদ নিয়ে ছবিটির কাহিনি আবর্তিত। এই মার্কিন নাটকটি নিয়ে এর আগেও চলচ্চিত্র হয়েছে। ছবিটি করেছেন স্টেনলি ক্রামার। এবার হচ্ছে কলকাতায়। মূল লেখক ছিলেন জেরম লরেন্স ও রবার্ট এডউইন লি। ১৯২৬ সালে লেখা তাঁদের এই
উপন্যাস নাটকে রূপ পায়। এটি নিয়ে বিদেশে টেলিভিশন সিরিজও হয়েছে। এবার সেই ঐতিহাসিক নাটকের অনুপ্রেরণায় চিত্রনাট্য লিখেছেন
শৈবাল মিত্র।

শৈবাল মিত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নাটকটি পড়েছি। এর প্রতিপাদ্য আমাদের বর্তমান সময়ের উপযোগী। তাই এটিকে নিয়ে আমি একটি ছবি বানানোর উদ্যোগ নিলাম। তিন ভাষায় হবে ছবিটি— বাংলা, হিন্দি আর ইংরেজিতে। ছবিতে সাঁওতালি ভাষারও বহু কথোপকথন থাকবে। এখানে (ভারতের পশ্চিমবঙ্গে) মুক্তির পর ছবিটি বাংলাদেশেও প্রদর্শনের উদ্যোগ নেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘নাটকটি পড়েই স্থির করে ফেলি আমি ছবিটি বানাবই। কিন্তু কাকে নিয়ে বানাব? তখন মাথায় ঘুরপাক খায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নাসিরউদ্দিন শাহর নাম। পাশাপাশি ছবির অন্যতম চরিত্র ধর্মযাজকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য উঠে আসে আমার বন্ধুসম মূকাভিনেতা পার্থপ্রতিম মজুমদারের নাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি যোগাযোগ করি এই তিন শিল্পীর সঙ্গে। সাড়াও পেয়ে যাই। মুম্বাই থেকে ছুটে আসেন নাসিরউদ্দিন শাহ, ফ্রান্স থেকে পার্থপ্রতিম আর আমাদের ঘরের মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো রয়েছেন আমাদের পাশে মহিরুহের মতো।’

মূলত বাংলা ভাষায় তৈরি এই ছবির পটভূমি পশ্চিমবঙ্গের খ্রিষ্টান–অধ্যুষিত হিল্লোলগঞ্জ শহরের একটি ঘটনাকে ঘিরে। সেখানেই রয়েছে একটি চার্চ। এই চার্চের প্রধান বা ধর্মযাজক হলেন প্যাস্টর হেরম্বচন্দ্র মাল। এই হেরম্বের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পার্থপ্রতিম মজুমদার। অন্যদিকে দুই আইনজীবীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নাসিরউদ্দিন শাহ।

এরই মধ্যে এই ছবির শুটিং হয়েছে কলকাতার কবরডাঙ্গার পারপেল নারায়ণ স্টুডিও, বীরভূমের বোলপুর, ইলম বাজার, মেসেঞ্জার, বর্ধমান, সিউরি, লিলুয়া এবং বীরভূমের সাত কাথিনিয়া গ্রামে। একদিন শুটিংয়ের ফাঁকে কথা হচ্ছিল মূকাভিনেতা পার্থপ্রতিম মজুমদারের সঙ্গে। বললেন, ‘এটা আমার সৌভাগ্য যে ভারতের দুই কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নাসির উদ্দিন শাহর সঙ্গে অভিনয় করতে পেরেছি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো আমাদের কাছে এক স্বপ্নের পুরুষ। আর নাসিরউদ্দিন শাহ হলেন মুম্বাইর ক্ল্যাসিক ছবির দুনিয়ার পুরুষ।’ পার্থপ্রতিম মজুমদার প্রথম আলোকে আরও বললেন, ‘আগে থেকে শৈবাল মিত্রর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। তিনি যখন আমাকে বললেন, এই ছবিতে আরও অভিনয় করবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং বলিউড তারকা নাসিরউদ্দিন শাহ। অমি নাম শুনে তো হতবাক হয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানাই। বলি আমি আসব। এ সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাই না। তাই তো কলকাতার
এই প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ছবির শুটিং করার জন্য ছুটে আসি সুদূর প্যারিস থেকে। এই অভিনয়ের কথা আমি আজন্ম মনে রাখব।’

নাসিরউদ্দিন শাহ বলেছেন, ‘অনেক দিন ধরে আমার একটা ইচ্ছে ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করার। সেই ইচ্ছা পূরণ করে দিলেন শৈবাল মিত্র। আমি অভিনয় করতে পারলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এটা আমার দারুণ পাওয়া। আমি দারুণ গর্বিত।’ অন্যদিকে নাসিরউদ্দিন শাহর সঙ্গে অভিনয় করতে পেরে গর্বিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। বলেছেন, আমি তো নাসিরউদ্দিন শাহর সঙ্গে অভিনয় করার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। এবার অভিনয় করতে পেরে গর্বিত।’