কয়েক টুকরো মেরিল

ছেলেবেলায় ইয়েল স্কুল অব ড্রামায় পড়াশোনা করার সময় শেক্‌সপিয়ারের আ মিড সামার নাইটস ড্রিম–এর হেলেনা চরিত্র দিয়ে শুরু এখনো পর্দায় মেরিল স্ট্রিপের আবেদন কমেনি
ছেলেবেলায় ইয়েল স্কুল অব ড্রামায় পড়াশোনা করার সময় শেক্‌সপিয়ারের আ মিড সামার নাইটস ড্রিম–এর হেলেনা চরিত্র দিয়ে শুরু এখনো পর্দায় মেরিল স্ট্রিপের আবেদন কমেনি

১৯৪৯ সালের ২২ জুন জন্মেছিলেন মেরিল স্ট্রিপ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে। বাবা ছিলেন ফার্মেসির ম্যানেজার। মা শিল্পী। মেরির ছিল দুই ভাই। মেরিলের মায়ের পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের রক্ত, বাবার দিকে ছিল হল্যান্ডের রক্ত। শিশুকাল কেটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বার্নার্ডসভিলে। এখানেই পড়াশোনা। নাটক নিয়ে ছিল আগ্রহ। অভিনয়শিল্পী জিন আর্থার ছিলেন তাঁর প্রশিক্ষক। ইয়েল স্কুল অব ড্রামায় পড়াশোনা করার সময় নাটকে ডুবে যান। সে সময় শেক্​সপিয়ারের আ মিড সামার নাইটস ড্রিম–এর হেলেনা চরিত্রে যেমন অভিনয় করেছেন, তেমনি ক্রিস্টোঢার ডুরাংগের নাটকে ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধের ভূমিকায়ও অভিনয় করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েলের পড়াশোনা শেষে মেরিল চলে আসেন নিউইয়র্কে। সেখানে নাটকের পর নাটকে অভিনয় করতে থাকেন। এর মধ্যে শেক্​সপিয়ারের হেনরি ফিফথ, টেমিং অব দ্য শ্রু, মেজার ফর মেজার ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করেন। শেষ নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন স্যাম ওয়াটারস্টোন ও জন সেজেল। সেজেলের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে মেরিলের।

ধাক্কা

১৯৭৫ সালে কিংকং ছবিতে মূল নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রযোজক দিনো দ্য লরেন্টিসের ছেলে মেরিল স্ট্রিপকে বাবার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। মেরিলকে দেখলেন প্রযোজক, তারপর ছেলেকে ইতালিয়ান ভাষায় বললেন, ‘এই শূকরীকে কোত্থেকে নিয়ে এলি? যে কুৎসিৎ!’

প্রযোজকের মাথা ঘুরে গেল, যখন তিনি শুনলেন, মেরিল ইতালীয় ভাষাতেই উত্তর দিলেন ‘আমার খুবই খারাপ লাগছে আমি আপনার পরীক্ষায় উতরাইনি বলে।’

এগিয়ে চলা

এর দুই বছর পর মেরিল জুলিয়া ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব পান। এই মেলোড্রামার খুব ছোট একটি চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন। ছবিটি দর্শকসমাদৃত হয়। তিনটি অস্কারও পেয়ে যায় জুলিয়া। এরপর ডিয়ার হান্টার ছবিতে অভিনয় করেন মেরিল। কেন তিনি এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন? গল্প ভালো লেগেছিল বলে? একেবারেই না। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন জন সেজেল। সেজেল দুই নায়কের এক নায়ক ছিলেন বলেই মেরিল সে ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দুই পুরুষ চরিত্রের মধ্যে একটা নারী চরিত্রের দরকার ছিল। আমি সেই চরিত্রে অভিনয় করেছি। এটুকুই।’ এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি অস্কারে মনোনয়ন পান। তবে সেই বছর অস্কার পান ম্যাগি স্মিথ। একই বছর গোল্ডেন গ্লোবের জন্যও তাঁর নাম আলোচনায় আসে, কিন্তু সেটা পান ডায়ান ক্যানন। চলচ্চিত্র সমালোচক ড্যান জারডেন লিখেছিলেন, ‘স্ট্রিপ সর্বকালের সেরা অভিনেত্রী।’ নিউইয়র্ক টাইমস–এ লিখলেন ভিনসেন্ট কেনবি, ‘নিউইয়র্কের মঞ্চে অসাধারণ অভিনয় করা মেরিল কাঁপিয়ে দিয়েছেন চলচ্চিত্রজগৎ।’

দুই ক্র্যামার ও অস্কার

ক্র্যামার ভার্সাস ক্র্যামার ছবিতে পাঁচ বছরের সন্তান নিয়ে ডাস্টিন হফম্যানের যুদ্ধটা যখন দেখছি, তখন কি ওই ছবিতে সন্তানের মায়ের প্রতি কোনো ধরনের সহমর্মিতার সৃষ্টি হয়? এ প্রশ্নের মিশ্র উত্তর আসবে। বেশির ভাগ মানুষই সন্তানের জন্য বাবা ক্র্যামারের যুদ্ধকেই উচ্চাসনে বসাবেন। দুষবেন মাকে। কিন্তু কেন সংসারটা ভাঙল, মা ক্র্যামার কেন ছেলে আর স্বামীকে ফেলে চলে গেল, তা নিয়ে খুব কম মানুষই ভাববেন। ছবিটা নতুন করে আরেকবার দেখতে অনুরোধ করি। দেখতে বলি শুধু মা ক্র্যামারের চরিত্রে মেরিল স্ট্রিপের অভিনয়। এবার আপনার মুখোমুখি হলে আপনি বলতে বাধ্য হবেন, ঠিক, দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন মেরিল।

এখানে বলে রাখি, চিত্রনাট্যে মা জোয়ানা ক্র্যামারকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছিল, তাতে মনে হতে পারত একগুঁয়ে, হিংস্র মেয়ে এটি। চিত্রনাট্য পড়ে মেরিল স্ট্রিপ বলেছিলেন, এই চরিত্রটি বাস্তবধর্মী হলো না। বাস্তবে যে রকম হয়, সে রকমভাবে তৈরি করা হোক চরিত্রটি। প্রযোজক স্ট্যানলি জেফি, পরিচালক রবার্ট বেন্টন, ‘মি. ক্র্যামার’ ডাস্টিন হফম্যান মেরিলের কথা মেনে নেন এবং চিত্রনাট্য পরিবর্তন করা হয়।

ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে। মেরিল স্ট্রিপের জন্য সালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর তিনটি ছবি মুক্তি পায় মেরিলের। সমালোচকদের কাছ থেকে মেরিল প্রশংসা পান। ক্র্যামার ভার্সাস ক্র্যামার অস্কারে নয়টি মনোনয়ন পায়, এর মধ্যে জিতে নেয় পাঁচটি। মেরিলও জিতে নেন অস্কার। পান গোল্ডেন গ্লোব।

প্রথম অস্কারের পর

মেরিল স্ট্রিপ।
মেরিল স্ট্রিপ।

অস্কার তো জুটে গেল। এবার হলিউডে একটার পর একটা ছবির প্রস্তাব আসতে লাগল। আমরা সেদিকে যাব না। আমরা বরং থামব ১৯৮২ সালে এসে। সোফিস চয়েজ নামে একটি ছবির কাছে এসে আমরা দেখব মেরিলকে। এ এক অন্য মেরিল। নাৎসিদের ভয়াবহ নিধনযজ্ঞ থেকে কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিল পোল্যান্ডের সোফিয়া। নির্যাতনশিবিরে সোফিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ওর ছেলে নাকি মেয়েকে বাঁচাতে চায় সে। যেকোনো একজনকে হত্যার শিকার হতেই হবে। সোফিকে একটা উত্তর দিতে হয়েছিল। সোফির ঠাঁই হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর যা হয়েছিল, সেটা দেখতে হবে পর্দায়। এ ছবি মেরিলকে এনে দিয়েছিল তাঁর দ্বিতীয় অস্কার আর তৃতীয় গোল্ডেন গ্লোব।

স্বনামধন্য টলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবের্ট লিখেছেন, ‘এই ছবিতে মেরিল বলে কাউকে আমি দেখিনি। মেরিলের কণ্ঠ শুনিনি। দেখেছি সোফিকে। কণ্ঠ শুনেছি সোফির। এটা সেই মেরিল স্ট্রিপ নন, যিনি অভিনয় করেছেন ডিয়ার হান্টার, ম্যানহাটান বা অন্য কোনো চলচ্চিত্রে।’

অনবদ্য মেরিল

নাহ্​! মেরিলকে নিয়ে লিখতে গেলে হয়ে যাবে বিশাল মহাকাব্য। তারচে বরং একটি অন্য রকম তথ্য দিয়ে লেখাটি শেষ করা যাক। অনেকেই মেরিলের একটা ক্ষমতা নিয়ে তাঁদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। সেটা হলো নানা দেশের উচ্চারণে ইংরেজি বলার পারঙ্গমতা। আউট অব আফ্রিকা ছবিতে ড্যানিশ উচ্চারণ, দ্য আয়রন লেডিতে (এ ছবির জন্য তৃতীয় অস্কারটি পান) ব্রিটিশ উচ্চারণ, দ্য ব্রিজেস অব মেডিসন কাউন্টিতে ইতালীয় উচ্চারণে কথা বলেন মেরিল। সোফিস চয়েজ ছবিতে তিনি পুরোপুরি পোলিশ উচ্চারণে কথা বলেছেন। এ জন্য তিনি পোলিশ ভাষা শিখেছেন রীতিমতো পড়াশোনা করে। কেন তিনি চরিত্র অনুযায়ী উচ্চারণ ঠিক করে নেন, এ রকম প্রশ্ন বারবার শুনতে হয় মেরিলের, বারবারই খুবই অবাক হন মেরিল। তিনি বলেন, ‘আমি অভিনয় করব এক দেশের মানুষের চরিত্রে, আর আমার নিজের উচ্চারণে কথা বলব, এ কি হতে পারে?’