মাইলস: চল্লিশেও চলতি

মাইলস ব্যান্ডের ৪০ বছর পূর্তি উদ্​যাপন শুরু হবে যুক্তরাষ্ট্র সফর দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের ১২টি শহরে একক শোতে অংশ নেবে এ দল। ২২ জুন নিউজার্সির শোর মধ্য দিয়ে তারা যাত্রা করবে। এরপর সেপ্টেম্বরে যাবে কানাডায়। সেখানেও ছয়টি শো হবে। চলতি সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরে কনসার্ট করার এই ঘোষণা দিল মাইলস। লম্বা এই সফরে বেরোনোর আগে দলের সদস্যরা আমাদের সঙ্গে আড্ডায় স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন।


১৯৮২ সালের একটা দৃশ্য আমরা কল্পনা করার চেষ্টা করি।

চোখেমুখে চাপা রোমাঞ্চ নিয়ে ঢাকার ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোয় ঘুরঘুর করছিলেন একদল তরুণ। তাঁদের হাতে একটি নতুন ব্যান্ডের গানের অ্যালবাম। অ্যালবামের নাম মাইলস। ব্যান্ডের নামও তা-ই। সে সময় তখনো দেশের অডিও–শিল্পের বাজার সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই শ্রোতাদের হাতে গান পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন স্বয়ং ব্যান্ডের সদস্যরা। এরপর থেকে শ্রোতারাই হয়ে উঠেছেন মাইলসের গানের ফেরিওয়ালা। ১৯৮২ সালে প্রথম অ্যালবাম বেরোলেও মাইলস যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৭৯ সালে।

১৯৮০ বা ১৯৯০–এর দশকে এ দেশে যাঁরা ব্যান্ড সংগীতের ভক্ত হয়েছেন, তাঁদের অনেকের কাছেই মাইলস ‘প্রথম প্রেমের মতো’। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা কেউই এখন আর দলে নেই। তবু দেখতে দেখতে মাইলসের ৪০ বছর হলো। ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে মাইলস কিন্তু ‘ফিরিয়ে দাও, হারানো দিনগুলো এভাবে চলে যেয়ো না’ গেয়ে থমকে যাচ্ছে না। বরং তাকাচ্ছে সামনের দিকে। আমরা তাদের মুখোমুখি বসেছিলাম ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। যে হোটেলে মিশে আছে ব্যান্ডটির বহু স্মৃতি।

ফিরে দেখা

এখন মাইলসের সদস্যসংখ্যা ৫। আছেন শাফিন আহমেদ, হামিন আহমেদ, মানাম আহমেদ, সৈয়দ জিয়াউর রহমান তূর্য ও ইকবাল আসিফ জুয়েল। শাফিন, হামিন, মানাম প্রায় শুরু থেকেই আছেন। তূর্য আর জুয়েলের কথা বলতে গিয়ে শাফিন মজা করে বললেন, ‘ওরা তো বাচ্চা ছেলে!’

‘আমি ছিলাম মাইলসের ভক্ত। প্রতিটা টিউন মুখস্থ ছিল, তাই গানগুলো তুলতে সময় লাগেনি। ১৯৯৮ সালে, উইন্টার গার্ডেনে থার্টি ফার্স্ট নাইটের কনসার্টে আমি প্রথম মাইলসের সঙ্গে স্টেজে উঠি,’ বলছিলেন জুয়েল। তূর্যর শুরুর গল্পটা অবশ্য হামিন বললেন, ‘১৯৯৬ সালে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে কনসার্ট করতে যায় মাইলস। সে সময় আমরা তূর্যকে প্রায় ৪৫টা গান তুলতে বলে গিয়েছিলাম। ফেরার পর ওর আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা। ফার্মগেটে, আমাদের প্যাডে বসে তূর্য একা একা প্র্যাকটিস করত। ওই প্র্যাকটিস প্যাড নিয়ে অনেক ভুতুড়ে গল্পও আছে...’

‘ছোট’দের শুরুর গল্প শুনে হামিনেরও মনে পড়ল তাঁর শুরুর কথা। বলছিলেন, ‘হ্যাপি, ফরিদ, রবিন, কামাল—ওরা ছিল মাইলসের শুরুর দিকের সদস্য। কামাল সে সময়ের আইকনিক ড্রামার। ফরিদ প্রচণ্ড গোছানো। আর হ্যাপির সঙ্গে জ্যাম করলেই অনেক কিছু শেখা যায়। এত দারুণ সব মিউজিশিয়ানের সঙ্গে হঠাৎ এসে যোগ দেওয়া কিন্তু সহজ ছিল না। শুরুতেই ওরা আমাকে ৩০টা গানের তালিকা ধরিয়ে দিয়েছিল। তা-ও তুলতে হয়েছিল দুই দিনের মধ্যে!’

যেখান থেকে শুরু হয়েছিল মাইলসের যাত্রা। সেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ব্যান্ডের বর্তমান সদস্যরা (বাঁ থেকে) হামিন, তূর্য, মানাম, আসিফ ও শাফিন। ছবি: সুমন ইউসুফ
যেখান থেকে শুরু হয়েছিল মাইলসের যাত্রা। সেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ব্যান্ডের বর্তমান সদস্যরা (বাঁ থেকে) হামিন, তূর্য, মানাম, আসিফ ও শাফিন। ছবি: সুমন ইউসুফ

আলাপটা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হচ্ছিল বলেই বোধ হয় স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসতে সুবিধা হলো। শ্রোতাদের কাছে আত্মপ্রকাশের আগে এই হোটেলেই গান গাইত মাইলস। মাইলসের গানের যে গোছানো সমন্বয়, পরিচ্ছন্ন শব্দায়োজন, এই চর্চা ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকেই হয়েছিল বলে মনে করেন হামিন-শাফিনরা। হামিন স্মৃতিচারণা করেন, ‘পেশাদার ব্যান্ড হিসেবে আমাদের প্রথম চুক্তি হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সঙ্গে। সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ রাত এখানে গান করতাম। শ্রোতা ছিল বেশির ভাগই বিদেশি। তার ওপর নানা রকম নিয়মকানুন। আমাদের সবাইকে এক রকম পোশাক পরে আসতে হবে। ভলিউম, মিউজিক হতে হবে খুবই নিয়ন্ত্রিত। শুরুতেই এই চর্চা আমাদের অনেক বেশি পরিণত করেছে।’

যত সময় গেছে, মাইলস পরিণত হয়েছে আরও। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের শব্দায়োজন, শব্দ প্রকৌশলে তাদের অবদানের কথা গানের জগতের মানুষ তো বটেই, শ্রোতারাও জানেন।

মাইল পেরিয়ে মাইলস

মাইলসের প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম প্রতিশ্রুতি বেরিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শাফিন বলছিলেন, ‘আশির দশক থেকেই তো শ্রোতারা আমাদের গান শুনছে। একসময় বেশ সমালোচনাও হয়েছে। আমরা আদৌ বাংলা গান করতে পারি কি না, সেটা নিয়েও অনেকে কথা বলেছে। সেই ভাবনা থেকেই প্রথম অ্যালবাম—প্রতিশ্রুতি। দ্বিতীয় অ্যালবামে মানুষের প্রত্যাশা বাড়ল আরও, তাই নাম দিলাম প্রত্যাশা।’

প্রথম দুটি অ্যালবামের নামের শুরুতে ‘প্র’ ছিল বলেই মাইলসের অ্যালবামের নামে ‘প্র’ থাকা একসময় অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। প্রত্যয়, প্রয়াস, প্রবাহ, প্রতিধ্বনি, প্রতিচ্ছবি, প্রবর্তন—অ্যালবামের গানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘প্রথম প্রেমের মতো’, ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘ধিকি ধিকি’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’, ‘নীলা’, ‘কী জাদু’, ‘হৃদয়হীনা’, ‘জ্বালা জ্বালা’, ‘পিয়াসি মন’, ‘বলব না তোমাকে’, ‘প্রিয়তমা মেঘ’...মাইলস মঞ্চে উঠলে গানগুলো গাওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নেন শ্রোতারা। তাই ৪০ বছর পেরিয়ে আরও দূর যেতে চায় দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তা পাওয়া ব্যান্ডটি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরে কনসার্ট করার ঘোষণা দিয়েছে মাইলস। গানের ঝোলা নিয়ে শিগগিরই বেরিয়ে পড়বে তারুণ্যে ভরপুর এই ৪০ পেরোনো ব্যান্ড।