মনের মাধুরী মেশানো আড্ডা

বসার ঘর গোলাপি, পড়ার ঘর সবুজ। আর শোবার ঘর হবে নীল, আকাশের মতো। একেকটা ঘরের সঙ্গে রঙের এই মিল মাথায় গেঁথে গেছে বছর বিশেক আগে। মাঝেমধ্যে সেই কথাগুলো নস্টালজিয়া হয়ে মাথায় চেপে বসে। দেয়ালের রঙের সঙ্গে মনের মাধুরী মেশালে তা যে মনে গেঁথে থাকে, তা শিমুল–চৈতী জুটির জনপ্রিয়তা দেখে বোঝা যায়। দুই দশক পরেও তাঁদের কেউ ভোলেনি। আমরা একসময় বিজ্ঞাপনচিত্রে সাড়াজাগানো এই জুটির সঙ্গে আড্ডা দিতে বসেছিলাম। তাঁরা বললেন তখন আর এখনকার কথা। লিখেছেন আদর রহমান


অনেক অনেক স্মৃতির নিচে চাপা পড়ে যাওয়া একটা তথ্য দিয়ে শুরু করি। সেটা হলো, এই রং নিয়ে মডেল ও অভিনয়শিল্পী মনির খান শিমুল ও লামিয়া তাবাস্​সুম চৈতীর যাত্রা আজকালের নয়। এ নিয়ে এটা তাঁদের ‘মনের মাধুরী রং’ বিষয়ক তৃতীয় বিজ্ঞাপনচিত্র। সবাই নস্টালজিক হয়ে যায় দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনচিত্রটি নিয়ে। টিভি, অনলাইনসহ সব মাধ্যমে সেই বসার ঘর গোলাপি, শোয়ার ঘর নীল আর স্টাডি সবুজ—এই বিজ্ঞাপনটিই খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এই জুটি এর আগেও আরেকটি বিজ্ঞাপন করেছিলেন রং নিয়ে, সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। সেখান থেকেই প্রথম ‘মনের মাধুরী মেশানো রং’ কথাটা সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। এরপর ১৯৯৮ সালে আসে এর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া বিজ্ঞাপনচিত্রটি। আর এই তো কিছুদিন আগে, প্রায় ২১ বছর পর এল তৃতীয় বিজ্ঞাপনচিত্রটি, যা এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইরাল’–এর তকমা পেয়ে গেছে। শিমুল–চৈতীর সঙ্গে আমাদের আড্ডা এই সূত্র ধরেই।

মনির খান শিমুল ও লামিয়া তাবাস্‌সুম চৈতী: বিশ বছর আগে ও পরে। ছবি: কবির হোসেন ও সংগৃহীত
মনির খান শিমুল ও লামিয়া তাবাস্‌সুম চৈতী: বিশ বছর আগে ও পরে। ছবি: কবির হোসেন ও সংগৃহীত

কোনোভাবে ব্যাটে–বলে মেলানো যাচ্ছিল না। চৈতী ও শিমুলের এখন কাজের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ আলাদা। একজন শিক্ষকতা ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত, আরেকজন ব্যবসা ও অভিনয়। একজন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ম্যারাথন ব্যস্ততায় থাকেন। তো আরেকজনের ছোটাছুটি শুরু হয় দুপুর থেকে, চলে রাত অবধি। তাই একটা সুবিধাজনক মধ্যবর্তী সময় বের করা হয়ে উঠছিল না। বেশ হিসাব কষেই আমরা গত মঙ্গলবার বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইউনিট্রেন্ডের কার্যালয়ে দুজনের সঙ্গে আলাপ করতে বসি। আর আলাপ শুরু হতেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন একেকজন।

যেভাবে শুরু

চৈতী শুরু করেন একেবারে প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্রটি থেকে। তিনি তখন ও লেভেল পরীক্ষা দিয়েছেন সবে। পড়াশোনার ফাঁকে সময় বের করে চৈতী একটু–আধটু মডেলিং করতেন। অভিনেতা ও নির্মাতা আফজাল হোসেনের সঙ্গে চৈতীদের পারিবারিক সম্পর্ক। তাই নিজের পরিচিতি আর এত সব প্রশংসার জন্য শুরুতেই চৈতী কৃতজ্ঞতা জানালেন আফজাল হোসেনের প্রতি। বললেন, ‘আফজাল আঙ্কেলই ১৯৯৪ সালের দিকে আমাকে রেক্সোনার বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে নেন। সেটা দিয়েই মানুষ আমাকে চিনতে শুরু করে। এরপর ১৯৯৬ সালে বার্জারের প্রথম বিজ্ঞাপনটিও আফজাল করেন এবং সেখানে শিমুল ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করা হয়।’ সবশেষ ২০০০ সালে আফজাল হোসেনেরই নির্দেশনায় ছবির মতো মেয়ে নামের একটি নাটকে শেষ অভিনয় করেছিলেন লামিয়া তাবাসসুম চৈতী। সেখানেও শিমুল ছিলেন চৈতীর বিপরীতে।

বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিংয়ে িনর্মাতা আদনান আল রাজীবের (বসা) সঙ্গে চৈতী ও শিমুল
বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিংয়ে িনর্মাতা আদনান আল রাজীবের (বসা) সঙ্গে চৈতী ও শিমুল


পর্দার জুটি নিয়ে দর্শকদের কৌতূহল

২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিমুল–চৈতীর নামটা দর্শক একসঙ্গে নিয়ে আসছেন। তাই অনেক দর্শকের মাথাতেই গেঁথে গেছে যে তাঁরা দুজন বোধ হয় পর্দার বাইরেও স্বামী–স্ত্রী। এ নিয়ে নাকি এই দুই শিল্পীর মধ্যে বেশ হাসাহাসি হয়, মজা করা হয়। অনেকে নাকি সামনাসামনি এসে প্রশ্নও করে ফেলেন। কিন্তু আসলে পর্দার বাইরে তাঁদের সম্পর্কটা কেমন? এর জবাব আমরা পেলাম শিমুলের কাছ থেকে। তিনি বললেন, ‘চৈতী তো আমার খুব আদরের ছোট বোন। বড় ভাইয়ের কাছে যেমন মানুষ এসে সব ভালো লাগা, মন্দ লাগা, জটিলতা আর আনন্দের কথা বলে, চৈতীও তেমন।’ এই কথার সঙ্গে একমত হয়ে চৈতীও বললেন, ‘ঠিক তাই। মিডিয়ায় যদি আমার কোনো বড় ভাই থেকে থাকে, সেটা শিমুল ভাই।’ আর মানুষের ভাবনা? সে নিয়ে হেসে চৈতী জানালেন, ‘আমাদের জুটির গ্রহণযোগ্যতা এত বেশি ও বাস্তবধর্মী যে আমাদের জন্য বিষয়টা বেশ আনন্দের।’

এখন যে যেখানে

মনির খান শিমুল ব্যবসা করছেন। সেই সঙ্গে সময় দিচ্ছেন অভিনয়েও। বললেন, সামনে কিছু ভালো ভালো কাজ করবেন। ওজন কমিয়ে পর্দার জন্য ফিট হয়ে উঠেছেন। আর চৈতী একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তাঁর স্বামী ও সন্তান নিয়ে সংসার গুছিয়েছেন। ২০ বছর পর বার্জারের পুরোনো বিজ্ঞাপনচিত্রের সিক্যুয়েল দিয়ে আবার শিমুল–চৈতীর ফেরায় শুধু দর্শক নয়, আনন্দ ভর করেছে দুই শিল্পী পরিবার ও পরিচিত মহলেও। চৈতী বলেন, ‘আমি ১৯ বছর পর অভিনয়ে ফিরলাম। শেষবার যখন কাজ করেছিলাম তখন দর্শকের ফিডব্যাক আসতে বেশ সময় লাগত। কিন্তু এখন কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অনেক অনেক ফিডব্যাক পাচ্ছি। এটা আমার জন্য নতুন। এমনকি আমি দেখছি আমার মেয়ে আমার বিজ্ঞাপনচিত্র ফেসবুকে শেয়ার করছে, আমার শিক্ষার্থীরা শেয়ার করছে। এই অনুভূতিগুলো নতুন ও ভালো লাগার।’

নির্মাতার কথা

এবারের বিজ্ঞাপনচিত্রটি নির্মাণ করেছেন আদনান আল রাজীব। আমরা কথা বলি তাঁর সঙ্গে। আদনানের রানআউট ফিল্মসের অফিসে বসে এই বিজ্ঞাপনচিত্র নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে তিনি বললেন, কাজটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এর থেকে যে ফলাফল তিনি পাচ্ছেন তা তাঁর সব ঝুঁকি আর ভয়কে ঝেড়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমাদের বুঝিয়ে বলেন আদনান—পুরোনো অতিজনপ্রিয় কোনো বিষয়ের নতুন উপস্থাপনা সব সময়ই কঠিন। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আগের দর্শকদের অনেক অনেক প্রত্যাশা আর নতুন দর্শকদের চাহিদা ও কৌতূহল মেটানোর বিষয়, সেই সঙ্গে বিজ্ঞাপনচিত্র যে প্রতিষ্ঠানের জন্য বানানো হচ্ছে অর্থাৎ বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ ও এজেন্সি ইউনিট্রেন্ডের চাহিদাকেও প্রাধান্য দিতে হয়। তাই ২০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করাটা বেশ চাপের ছিল। বলতে গেলে ২০ বছরের এই নস্টালজিয়াকে তৈরি করতে হয়েছে ২০ দিনে। এর প্রতিটি ছোট ছোট দিক, আবহ সংগীত থেকে শুরু করে নতুন সেট, দেয়ালের রং, নস্টালজিয়ার আবেগ আর ফিরে আসার আনন্দের ভারসাম্য—কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তুলে ধরা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল বটে।

বিজ্ঞাপনচিত্রে শিমুল ও চৈতীর পরিবারে যোগ হয়েছে ঐশী (বাঁ থেকে িদ্বতীয়) ও সাদ (ডানে)
বিজ্ঞাপনচিত্রে শিমুল ও চৈতীর পরিবারে যোগ হয়েছে ঐশী (বাঁ থেকে িদ্বতীয়) ও সাদ (ডানে)

পরিবারের নতুন সদস্য

আগে ছিলেন শিমুল আর চৈতী। ২০ বছরে এখন এই পরিবারে যোগ হয়েছে নতুন সদস্য। এই দুই সদস্যের নাম জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী আর সাদ নাওভি। শিমুল–চৈতীর দুই সন্তান হিসেবে ঐশী–সাদকে বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা গেছে। মজার ব্যাপার হলো, পর্দায় আমরা যেই পরিবারের ৪ সদস্যের মধ্যে যে রসায়ন দেখি, তা কিন্তু মাত্র এক দিনের ব্যবধানেই গড়ে উঠেছিল। বিজ্ঞাপনচিত্রের সেট বানানো হয়েছিল রাজধানীর বিএফডিসিতে। সেখানে মাত্র দুই দিনে এর শুটিং হয়। প্রথম দিনের শুটিংয়ে শুধু ঐশী আর সাদ ছিলেন। দ্বিতীয় দিন এক দিনের জন্য চৈতী ও শিমুল আসেন। আর ওই এক দিনেই মা–বাবা–ছেলে–মেয়ের মধ্যে গড়ে যায় অদ্ভুত সম্পর্ক। চৈতী বলেন, ‘এত বছর পর সেটে পা রাখতেই নস্টালজিয়া আমাদের জেঁকে ধরে। পর্দায় যে আবেগ সবাই দেখেছে, সেটা আসলে বাস্তব। আমরা শট দিয়ে খুব আবেগী হয়ে পড়েছিলাম। ঐশী আর সাদ লক্ষ্মী দুটো ছেলেমেয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম এ সময়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যা হবে কি না। কিন্তু না। আমি ঢুকতেই সাদকে বলেছিলাম, তুমি আমার ছেলে হচ্ছ? আর সাদ পাল্টা বলে উঠল, “আপনি আমার মা না?” ঐশীও তাই।’ ঐশীর প্রশংসা করলেন নির্মাতা আদনান আল রাজীবও। বললেন, ‘খুব ভালো করেছে ঐশী। এভাবেই এগিয়ে গেলে ঐশী খুব ভালো করবে। ওর ছোট ছোট অভিব্যক্তি, প্রতিটি ডিটেইল নিয়ে কাজ করার ধরন আমার খুব ভালো লেগেছে। ওর চেষ্টা চোখে পড়ার মতো।’