বিদেশনির্ভর চলচ্চিত্রের গান, কার লাভ কার ক্ষতি?

দেশের শিল্পী ও সংগীত পরিচালকের তৈরি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গান ‘দিল দিল দিল’ এর দৃশ্যে বুবলী ও শাকিব খান। তবে অনেকেই বিদেশি শিল্পী ও সংগীত পরিচালকের দিকেও ঝুঁকছেন
দেশের শিল্পী ও সংগীত পরিচালকের তৈরি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গান ‘দিল দিল দিল’ এর দৃশ্যে বুবলী ও শাকিব খান। তবে অনেকেই বিদেশি শিল্পী ও সংগীত পরিচালকের দিকেও ঝুঁকছেন

চলচ্চিত্রে ভালো গানের জন্য অনেক পরিচালক বিদেশ যাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, দেশে ভালো মানের শিল্পী, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক থাকা সত্ত্বেও বিদেশ যাওয়াটা মোটেও ঠিক নয়। যারা যাচ্ছেন, তাঁদের মতে, পেশাদারত্ব ও মানসম্মত গান তৈরির ক্ষেত্রে বহু বিকল্পের সুযোগ থাকায় তাঁরা বাইরে কাজ করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যারা বাইরে কাজ করেন তাঁদের মতে, দেশে সবারই মেধা আছে, শুধু মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারলে বাইরের চেয়ে অনেক ভালো কাজ দেশে সম্ভব।

দেশের চলচ্চিত্রে ভারতীয় সুরকার ও সংগীত পরিচালকদের মধ্যে নিয়মিত কাজ করছেন আকাশ সেন ও স্যাভি। এর বাইরেও আছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, ডাব্বু ঘোষাল ও লিংকন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া আলোচিত সিনেমা বসগিরি, রক্ত, অগ্নি, ডুব, দেবী, আয়নাবাজি, সম্রাট, নবাব, ঢাকা অ্যাটাক এবং সর্বশেষ পাসওয়ার্ড ছবিতে দেশের বাইরের শিল্পী ও সংগীত পরিচালকসহ অনেক শিল্পী কলাকুশলী কাজ করেছেন।

আগে থেকে বাংলাদেশে বিদেশি শিল্পীরা টুকটাক কাজ করলেও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার বদৌলতে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় বলে চলচ্চিত্রপাড়ার অনেকে মনে করেন। ২০১৩ সালে আমি শুধু চেয়েছি তোমায় চলচ্চিত্রে পরিচালক অনন্য মামুন বাইরের দেশের শিল্পী দিয়ে গান করান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে গুণী শিল্পী, গীতিকার ও সংগীত পরিচালকের অভাব নেই। কিন্তু গুণের অভাব আছে।’ বিষয়টি পরিচালক ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘দেখা যায়, আমি কোনো সংগীত পরিচালককে দিয়ে মিউজিক করিয়ে বললাম, গানটি অমুক শিল্পীকে দিয়ে গাওয়াব, এটা তিনি মানতে পারেন না। অথবা সুর করিয়ে অন্যকে দিয়ে সংগীত পরিচালনা করাব বললেও আপত্তি তোলেন। বিদেশে এ সমস্যায় পড়তে হয় না।’

জাজ মাল্টিমিডিয়া তাদের ছবির অর্ধেকের বেশি গানের কাজ করিয়েছে ভারত থেকে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলিমুল্লাহ খোকন বলেন, ‘বিদেশের শিল্পীরা অনেক বেশি পেশাদার। আমাদের দেশেও প্রতিভাবান শিল্পী, গীতিকার, সুরকার সংগীত পরিচালক আছেন। হঠাৎ যারা বেশি কাজ পান কিংবা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, তাঁদের আচরণে বড় একটা পরিবর্তন আসে। বাধ্য হয়ে বাইরে যেতে হয়।’

বসগিরি সিনেমা দিয়ে আলোচিত শামীম আহমেদ রনি। তিনি তাঁর প্রতিটি ছবিতে ভারতীয় শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বললেন, ‘দেশের একজন সংগীত পরিচালক গান বানানোর পর যদি ছবির পরিচালকের মনঃপূত না হয়, তবে সংগীত পরিচালক তা পরিবর্তন করতে চান না। তিনি বলেন, পরিচালকের বর্ণনামতোই তো গান তৈরি করেছেন, তাই এখন পরিবর্তন করবেন কেন? অর্থাৎ সংগীত পরিচালকেরা নিজের জায়গায় অনড় থাকেন। তাই আমরা দেশের বাইরে থেকে গান তৈরি করি। সেখানে এ সমস্যা নেই।’

সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চলচ্চিত্রের গানের ক্ষেত্রে পরিচালক যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই কাজটা হওয়া উচিত। এক গানের অনেকবার সংশোধন হতে পারে। এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। আমরাও তা দেখি। এসব কারণে দেশের বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দুঃখজনক।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিল্পীও বলেন, ‘কোনো সংগীত পরিচালকের সঙ্গে একটি গান নিয়ে কথা হয়, শুরুতে খুব আগ্রহ দেখান। কিন্তু সময়মতো গানটি তিনি দিতে পারেন না। কোনো গানের কথা কিংবা সুর পছন্দ হচ্ছে না বললে যেন অপরাধও হয়।’

সত্তা ছবির সংগীত পরিচালক বাপ্পা মজুমদার বলেন, ‘বিদেশের যেকোনো জিনিস ভালো, এই মানসিকতা আমাদের অনেক দিনের। এটা একধরনের মানসিক দীনতা। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় মানসিকতার পরিবর্তন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চলচ্চিত্রের দুজন গীতিকবি বলেন, এ দেশে কোনো গায়ক কিংবা সংগীত পরিচালক জনপ্রিয় হলে তাঁকে সময়মতো খুঁজেই পাওয়া যায় না। সংশোধনের কথা জানালে বলেন, এত বছর সংগীত পরিচালনা করছি, আমাদের আবার গান শেখাতে আসে! এমনও হয়, সংগীত পরিচালককে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পর শুনতে হয়, মাথায় সুর আসছে না। আরও ভাবতে হবে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, গানটা নিয়ে তিনি কিংবা তাঁরা কোনো কিছু ভাবেননি!’

গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘আমাদের মধ্যে উন্নসিকতা চরম আকার ধারণ করেছে। দূরের বাদ্যই আমরা শুনতে ভালোবাসি অথচ আমরা একবারও ভাবি না আমাদের সংস্কৃতি উন্নত।’