অবশিষ্ট টাকায় সার্থক এক আন্তর্জাতিক উৎসব

ভিয়েতনামের নাটক কিম তু–এর একটি দৃশ্য
ভিয়েতনামের নাটক কিম তু–এর একটি দৃশ্য

‘সত্তর ভাগ স্থানীয়, বিশ ভাগ ভারত, বাকি দশ ভাগ কোনো এক দেশের একক অভিনয়ের নাটক’—শুনতে বা পড়তে খারাপ লাগলেও এমনটিই ছিল এত দিনের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবের সৌষ্ঠব! তাতে অবশ্য খুব বেশি কথা ওঠেনি। বরং সীমিত সম্পদের (বাজেটের) যথাযথ ব্যবহারই ছিল স্থানীয় আয়োজকদের উদ্দেশ্য। 

সেসব এখন অতীত। এখন ঢাকায় আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব মানে সাত দিনে সাত দেশের নাটক। অন্তত এবারের উৎসবটি সে কথাই বলছে। ২০ জুন যে উৎসব শুরু হয়েছে বাংলাদেশের নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা দিয়ে, তা ২৬ জুন শেষ হয়েছে রাশিয়ার নিকোলাই জাইকভ থিয়েটারের লাইট পাপেট শো দিয়ে। মাঝখানে দর্শক দেখেছে ফ্রান্সের ও মাই সুইট ল্যান্ড, ভারতের ম্যাকবেথ, জয়তুন বিবির পালা, চীনের এফসিকে, নেপালের ঝিয়ালঞ্চা, ভিয়েতনামের কিম তু। 

শুধু মঞ্চ আলো করে নাটক মঞ্চস্থ হওয়া নয়, দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল প্রতিটি প্রদর্শনীতে। শুধু নাটক দেখাদেখিতে সীমিত ছিল না উৎসবের আয়োজন। দেশ–বিদেশের নাট্যাঙ্গনের বিদগ্ধজনদের সঙ্গে আলাপচারিতা অভিজ্ঞতা বিনিময় ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। 

উৎসবে এসেছিলেন ভিয়েতনামের হানয় একাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড থিয়েটারের ভিজিটিং প্রফেসর সুয়া সু পং। ঢাকার নাট্যচর্চা নিয়ে তাঁর অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, থিয়েটারের অনেক প্রযোজনা দেখেছেন তিনি। সেলিম আল দীনের নাটক দেখার অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের থিয়েটারের উন্নতি চোখে পড়ার মতো, খুবই উঁচু মানের। আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্র থেকে যে প্রকাশনাগুলো প্রকাশ করা হয়, তা খুবই মানসম্পন্ন এবং জরুরি। যার মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশ ও এশিয়ার থিয়েটার সম্পর্কে আরও বেশি বেশি জানতে পারে। তিনি মনে করেন, থিয়েটার সবচেয়ে ভালোভাবে কোনো দেশের সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের থিয়েটারের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে না পারলে তারা আমাদের থিয়েটার আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে কখনোই জানতে পারবে না।’ 

ফ্রান্সের নাটক ও মাই সুইট ল্যান্ড
ফ্রান্সের নাটক ও মাই সুইট ল্যান্ড

রতন থিয়ামের কথাও বাংলাদেশের থিয়েটার–চর্চার প্রশংসা মেলে। তাঁর মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি থিয়েটার–চর্চা হয় বাংলাদেশে। এবার সরাসরি সরকারের উদ্যোগে করা উৎসবটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। ২১ জুন সকালে তাঁর বেশ কিছু কথা মনে ধরেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘থিয়েটার একটা চর্চা। প্রযোজনা হলো একটা প্রকল্প। এর জন্য অনেক সময় দরকার। কখনো কখনো তিন-চার বছর লাগতে পারে। আমি যখন আমার কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট হই তখনই কেবল আমার কাছের বন্ধুদের দর্শক হিসেবে দেখাই। ভালো না হলে আমি উদ্বোধনের আগের দিনও প্রদর্শনী বাতিল করে দিই।’ 

কিছু প্রদর্শনীর কথা আলাদা করে না বললেই নয়। উৎসবের দ্বিতীয় দিনে দুটি নাটক ছিল। বাংলােদশ শিল্পকলা একাডিমীর পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে এদিন বিকেলে মঞ্চস্থ হয় নাটক ও মাই সুইট ল্যান্ড। সেখানে একক অভিনয় করেন নাট্যকার ও নির্দেশক কোরিন জাবের। মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধ এবং এর ফলে সৃষ্ট শরণার্থীদের জীবনের গল্প ছিল নাটকে। একজন সিরীয় নারী সিরিয়ার খাবার ‘কেবে’ রান্না করার সময় বলে যান যুদ্ধকালে তাঁর জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। দারুণ তাঁর অভিনয়। ২৩ জুন সন্ধ্যায় চীনের জোহো থিয়েটারের এফসিকে নাটকের মাধ্যমে দেখা গেল সংস্কৃতি-লোকাচার ছাড়া লোকের জীবন মরুময়। ২৬ জুন শেষ দিন সন্ধ্যায় রাশিয়ার নিকোলাই জাইকভের ‘লাইট পাপেট শো’ ছিল।

এত গুণীজন, এত আয়োজন হয়েছে মাত্র দেড় মাসের প্রস্তুতিতে—এমনটাই জানালেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। তিনি আরও জানান, এই উৎসব নিয়ে আয়োজক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদও ছিলেন দারুণ উচ্ছ্বসিত। উদ্বোধনের দিন তাঁর মন্তব্যে সেটি স্পষ্ট হয়। ‘আমি আজ দারুণ খুশি। কারণ সরকারি উদ্যোগে এবারই প্রথমবারের মতো আমরা একটি নাট্যোৎসবের আয়োজন করতে পেরেছি।’ ঠিক এ কথাগুলোই বলেছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী। 

তবে শুরুরও শুরু আছে। হুট করেই উৎসব শুরু হয়নি। যদিও সিদ্ধান্ত হয়েছিল হঠাৎ। আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ জানান, তিনি গিয়েছিলেন আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের উৎসব আয়োজনের আর্থিক সহায়তার জন্য। কিন্তু সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী জানালেন এই অর্থবছরে (২০১৮-১৯) অনুদান দেওয়ার মতো কোনো অর্থ আর নেই মন্ত্রণালয়ে। প্রতিমন্ত্রী জানালেন, খরচ হয়নি এমন কিছু অবশিষ্ট টাকা আছে। তবে এটা অনুদান দেওয়া যাবে না, সরাসরি মন্ত্রণালয় থেকে খরচ করতে হবে। যে–ই কথা, সে–ই কাজ। অবশেষে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর সরাসরি কোনো নাট্যোৎসবের আয়োজন করল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। নাট্যোৎসব বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ কেন্দ্র। সার্বিক সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন।