দুই ভাইয়ের এক 'সাউন্ড'

দুই ভাই— আরাফাত কীর্তি এবং আরাফাত মহসীন। ছবি: প্রথম আলো
দুই ভাই— আরাফাত কীর্তি এবং আরাফাত মহসীন। ছবি: প্রথম আলো

ব্যাংকে ঋণের জন্য ধরনা দিতে গেলে হয়তো সময় লেগে যেত অনেক। ক্ষয় হয়ে যেত জুতার তলা, কিন্তু আরাফাত কীর্তি এবং আরাফাত মহসীনকে জুতার তলা ক্ষয় করতে হয়নি। তাঁরা এসব না করেই পেয়ে গিয়েছিলেন ঋণ। তবে ব্যাংক থেকে নয়, মায়ের কাছ থেকে। সেটা দিয়েই করেছিলেন স্টুডিও। নিয়মিত হয়েছেন গানে। বছর পেরোতেই মায়ের সেই টাকা তো শোধ করেছেনই, আবার স্টুডিওটাও বড় করেছেন।

আরাফাত কীর্তি আর আরাফাত মহসীনকে মানুষ চেনে কীর্তি আর নিধি নামে। মহসীনের ডাকনাম তো নিধি। সম্প্রতি ঢাকার নিকেতনে তাঁদের স্টুডিওতে বসে কথা হয় সংগীতশিল্পী দুই ভাইয়ের সঙ্গে। আলাপের শুরুতেই জানতে চাই—‘আপনারা তো পেছনের মানুষ। শব্দ, মিউজিক, গান নিয়ে কাজ-কারবার। মানুষ আপনাদের কেন চিনবে বা মনে রাখবে বলুন তো?’

বড় ভাই হিসেবে কীর্তি ফ্লোর নেন আগে, উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘চেনাটা কি খুব জরুরি?’ এবার নিধির পালা, ‘আমরা দুই ভাই অনেকটা দরজির মতো। ও কাপড় কাটে। আমি সেলাই করি। মানে কীর্তি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার (শব্দ প্রকৌশলী) হিসেবে কাজ করে আর আমি মিউজিক ডিরেক্টর (সংগীত পরিচালক)। যারা মিউজিক ভালোবাসে বা বোঝে তারা ঠিকই চিনতে পারবে বা মনে রাখবে আমাদের।’ যোগ করেন কীর্তি। ‘আমরা আসলে চেনা-জানার দিকে বেশি গুরুত্ব দিই না। আমরা যদি নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করে যাই তাহলে সবাই এমনিতে চিনবেন, মনে রাখবেন।’

এই ‘ঠিকঠাক’ কাজটা কয়েক বছর ধরে নিয়মিত করে যাচ্ছেন দুই ভাই—কীর্তি ও নিধি। অসংখ্য দেশি বিজ্ঞাপনের সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন এই ভ্রাতৃজুটি। তবে কাজের গল্প বলার আগে নিজেদের শুরুর গল্প দিয়ে আড্ডা জমান নিধি। 

বাড়িতে একটা গানের পরিবেশ ছিল। বাবা-মা দুজনই গান পছন্দ করতেন। সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে বাবা হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন। সঙ্গে সন্তানেরা। হঠাৎ করেই ২০০৬ সালে বাবা মারা যান। সংসারের হাল ধরেন মা। ওই সময় একটি বেসরকারি রেডিও স্টেশনে চাকরি শুরু করেন কীর্তি। বড় ভাই যখন সুর আর শব্দযন্ত্র নিয়ে কাজ শুরু করলেন ছোট ভাই আর বসে থাকলেন না। যদিও দুই ভাইয়ের জীবনের লক্ষ্য মূলত গানকে ঘিরে ছিল না। তবু পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরনের শব্দ আর সুর নিয়ে খেলতে শুরু করেন তাঁরা। এই ফাঁকে ২০০৯ সালে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে চলে যান কীর্তি। নিধি যেন আরও একটু স্বাধীনতা পেয়ে যান। ওই সময় দু-চারজন চিনতে শুরু করেছেন কীর্তি ও নিধিকে। প্রথমে তাঁরা সবার নজরে আসেন মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংকের একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে সুর ও সংগীতের কাজ করে। সেই কাজটা অবশ্য এনে দেন তাঁদের পারিবারিক বন্ধু রাজীব আশরাফ। ওই বিজ্ঞাপনটাই একদিন মাকে দেখিয়ে নিধি বলেন, ‘এই বিজ্ঞাপনের মিউজিক আমার করা।’ বুটিক ব্যবসায়ী মা পুরো খুঁটিনাটি শুনে নেন। জেনে নেন, এই মিউজিক কোথায় কীভাবে করা হয়েছে। নিধি সহজ করে উত্তর দেন, এগুলো বিভিন্ন স্টুডিও ভাড়া নিয়ে করেছে। মা জানতে চান স্টুডিও করতে খরচ কেমন? ৩ লাখ টাকা শুনে সেই ‘লোন’ পাস করেন মা। 

বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনটা প্রচারের পর থেকেই সাড়া পড়ে যায়। বিজ্ঞাপনচিত্রের সুর ও সংগীতায়োজন করার জন্য ধীরে ধীরে ডাক আসতে থাকে নিধির। লন্ডন থেকে কীর্তিও নানাভাবে সহযোগিতা করেন দেশে থাকা ভাইকে। তারপর ডাক আসে আরেক মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারটেল থেকে। শিহাব শাহীনের ভালোবাসি তাই নামের একটি টেলিছবিতে ‘জলকনা’ নামে একটি গান করেন নিধি। তারপর থেকে চেনা মুখ হয়ে যান তিনি। 

এরপর অসংখ্য বিজ্ঞাপন, টেলিছবিতে গান করেছেন এই দুই ভাই। ২০১২ সালের দিকে দেশে ফেরেন কীর্তি। আগে স্টুডিও ছিল মিরপুর ডিওএইচএসের বাসাতেই। কিন্তু কীর্তি দেশে আসার পর তাঁদের মা আবারও দুই ছেলের পাশে দাঁড়ান। এবার বিনিয়োগ করেন তিনিও। তা-ও ৭ লাখ টাকা। স্টুডিও গড়েন নিকেতনে। 

তারপর থেকে দুই ভাই সমানতালে কাজ করছেন। তাঁদের সুর দেশের সীমানাও ছাড়িয়েছে। ভারতের বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্য সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন এই দুই ভাই। করেছেন রেদওয়ান রনির আইসক্রিম চলচ্চিত্রের আবহসংগীত। এ ছাড়া সম্প্রতি কোরিয়ায় বুশান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে উদ্বোধন হওয়া বাংলাদেশের ছবি ইতি, তোমারই ঢাকা-তেও এই দুই ভাইয়ের সুর রয়েছে। 

সামনের দিনগুলো নিয়ে কথা বলেন দুই ভাই। সবাই চিনছে, শুনছে তাঁদের সুর—এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তবে নিজেরাও গান করেন মাঝেমধ্যে। কনসার্টেও হাজির হন তাঁরা। জনপ্রিয় গান শোনার আবদার করেন শ্রোতারা।