হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে সুরের সন্ধিক্ষণে

হৈমন্তী শুক্লা ও সমরজিৎ রায়
হৈমন্তী শুক্লা ও সমরজিৎ রায়

দিদিকে বললাম, ‘ঝড় হয়ে এলাম।’ বললেন, ‘সুর দিয়ে শান্ত করে দে।’


ঝড়বাদলের এক সন্ধ্যায় উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে আমার জীবনের প্রথম সাক্ষাৎ ঠিক এভাবেই হয়েছিল তাঁর কলকাতার গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটে। গত ২৫ মে সন্ধ্যায় যখন দিদির বাড়িতে পৌঁছালাম, কাকতালীয়ভাবে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়ে গেল। কিন্তু দিদির সেই মনভোলানো হাসি তুমুল ঝড়কে শিথিল করে মনে যেন প্রশান্তির দোলা দিয়ে গেল। সত্যি কথা হলো, দিদিকে দেখে আমি কাঁপতে শুরু করেছিলাম, কারণ এই দেখা করার উদ্দেশ্য শুধু দেখা করাই ছিল না, বরং আমার কথা ও সুরে একটি দ্বৈত গানের রেকর্ডিংয়ের জন্য তাঁকে গান তুলে দেওয়া ছিল উদ্দেশ্য।

মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে আপন করে নিয়ে আমার সেই ভয় দূর করে দিলেন তিনি। দিদির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি, বিভিন্ন পুরস্কার আর গুণী সব শিল্পীর ছবিতে সজ্জিত তাঁর ড্রয়িং রুম। দিদির গানের ঘরে বসে মনটা আরও বেশি ফুরফুরে হয়ে ওঠে। দেয়ালে টাঙানো ছিল কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দের বড় একটি ছবি। এই ছবি দেখিয়ে দিদি বললেন, ‘এমন শিল্পী আর হবেনা রে।’

চা খেতে খেতে দিদির সঙ্গে কথা হচ্ছিল অনেক কিছু নিয়ে। তারপর বললেন গানটা তাঁকে শিখিয়ে দিতে। দিদির সঙ্গে এটাই আমার প্রথম কাজ। দিদির সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে আমার লেখা, সুর ও সংগীতায়োজনে ‘তুমি ভোরের পাখির মতো’ শিরোনামের এই গানের ভিডিও ১১ জুলাই অবমুক্ত করা হবে গানছবি এন্টারটেইনমেন্টের ইউটিউব চ্যানেলে। গানটি আমি একটু একটু করে গাইছি, দিদি গানটি গেয়ে তুলে নিচ্ছিলেন আর বাহ্ বাহ্ বলছিলেন। ততক্ষণে ভয় কেটে একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছি।

হৈমন্তী শুক্লার গানের ঘরে তাঁকে গান তুলে দেন সমরজিৎ রায়
হৈমন্তী শুক্লার গানের ঘরে তাঁকে গান তুলে দেন সমরজিৎ রায়

বারবার বলছেন, ‘আহা কী সুরটা করেছিস!’ কিছু কিছু জায়গায় থামিয়ে বললেন, ‘আহা রে এই নোটটা এমনভাবে লাগিয়েছিস, আমি তো আমাদের সময়ে ফিরে যাচ্ছি। এখনকার ছেলে হয়ে তুই এই সুরটা এভাবে লাগাবি, আমি ভাবতেই পারছি না।’

মনে আরও বেশি সাহস পেলাম। বললেন, এ রকম ক্ল্যাসিক্যাল গান যেন ওনাকে আরও দিই। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে দিদির কাছ থেকে সেদিন বিদায় নিয়ে চলে গেলাম আমার দাদু উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী মৃণাল চক্রবর্তীর বাড়িতে, যেখানে আমি রেকর্ডিংয়ের দিনগুলোতে গিয়ে উঠেছিলাম।

৩০ মে যথারীতি জেএমডি স্টুডিওতে হাজির হলাম। পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী দুপুর ২টায় হাজির হলেন দিদিও। গানটি আরও একবার তুলে দিলাম ওনাকে। শুরু হলো রেকর্ডিং। আহা এই বয়সেও কী অসাধারণ গাইলেন দিদি! আমিও সুযোগ বুঝে দিদিকে কিছু অন্যভাবে গাইতে বললাম। দিদি বললেন, ‘আরে এত কঠিন কাজ দিচ্ছিস, এই বয়সে কি গাইতে পারবো রে!’ বললাম, ‘দিদি খুব পারবেন।’

হৈমন্তী শুক্লার গানের ঘর
হৈমন্তী শুক্লার গানের ঘর

এত বড় একজন শিল্পী আমার কথামতো সুবোধ বালিকা হয়ে গাইলেন—দেখে খুব অবাক হয়েছি।

জেএমডি স্টুডিওতে গান রেকর্ডিংয়ের ফাঁকে
জেএমডি স্টুডিওতে গান রেকর্ডিংয়ের ফাঁকে

দিদি যেহেতু এখন অনেক নিচের স্কেল থেকে গান করেন, তাই স্বাভাবিকভাবে আমার জন্য তাঁর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া একটু কঠিন ছিল বটে। গান শেষ করে এবার এল ভিডিওর পালা। বললেন, ‘আরে আমাকে একটু চুলটুল ঠিক করতে দে, বুড়ো হয়েছি বলে কি একটু সাজুগুজু করব না! আমি কি দেখতে আগে সুন্দরী ছিলাম না?’ বলে হাসছিলেন। বললাম, ‘দিদি, আপনি এই বয়সেও যথেষ্ট সুন্দরী, আপনি হলেন চিরসবুজ।’

বারবার আমি নিজের চুল ঠিক করে নিচ্ছি, তাই আমাকে নিয়ে বেশ রসিকতাও করেন দিদি। যাওয়ার আগে সরল মনে বললেন, ওনার কণ্ঠ যেন আরও সুন্দর করে দিই মিক্সিংয়ে। রেকর্ডিং শেষ করে সেদিন রাতে আবার যেতে হয়েছিল দিদির বাড়িতে। আরও গল্প করলাম। একপর্যায়ে বললেন, ‘কি রে আমার গলা তোর পছন্দ হয়েছে তো? আমাকে দিয়ে আর কোনো গান গাওয়াবি না?’ হেসে বললাম, ‘কী যে বলেন দিদি, আপনি আমার গান গেয়েছেন, এটাই আমার পরম সৌভাগ্য। শিগগির আরও কিছু গান আপনার জন্য তৈরি করে আপনার কাছে হাজির হব।’ শুনে খুশি হলেন দিদি। বললেন, ‘অপেক্ষায় থাকলাম।’ দিদির সঙ্গে গান করার অনেক দিনের ইচ্ছের পূর্ণতা নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছি।

সমরজিৎ রায় ও হৈমন্তী শুক্লা
সমরজিৎ রায় ও হৈমন্তী শুক্লা

সত্যি এত বড় শিল্পী হয়ে ছোটদের প্রতি এমন আন্তরিকতা, ভালোবাসা এবং সহযোগিতা—এ শুধু হৈমন্তী দিদিকেই মানায়। ‘জ্ঞানের ভান্ডার যাঁর যত সমৃদ্ধ, তাঁর মাথা ততটাই নুয়ে থাকে।’ এই কথাটি দিদির বেলায় পুরোপুরি প্রযোজ্য। যদিও আমরা এই উক্তির যথাযথ ব্যবহার নিজেদের সংগীতজীবনে কতটুকু করতে পারি, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

দিদির সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।