বাংতান সুনয়েনদানের গান শুনেছেন তো?

>কোরিয়ান পপ বা কে পপের ভক্তের সংখ্যা এ দেশে বেড়েই চলছে। আবার অনেকের অপছন্দের তালিকার শীর্ষেও কে পপের ব্যান্ডগুলো। গান, সুর, কথা, গানের পরিবেশনা, শিল্পীদের বেশভূষা, ব্যক্তিত্ব—সবকিছুতেই পশ্চিমা পপ গানের জগৎ থেকে আলাদা দক্ষিণ কোরিয়ার এই ঘরানা। জনপ্রিয় কে পপ ব্যান্ডগুলো নিয়ে আমাদের এই ধারাবাহিক আয়োজন। শুরুতেই বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত ব্যান্ড ‘বিটিএস’কে নিয়েই আজকের লেখা। 
বিটিএসের সদস্যরা
বিটিএসের সদস্যরা

বিটিএস বা বাংতান সুনয়েনদান (Bangtan Sonyeondan) ২০১৩ সালের ১২ জুন সাত সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ব্যান্ডের প্রথম গান ছিল ‘নো মোর ড্রিম’। একদম শুরু থেকেই সামাজিক বিষয়গুলো ফুটে উঠছিল ব্যান্ডের গানে। বোঝা যাচ্ছিল, এই দলের মধ্যে ব্যতিক্রমী কিছু আছে। মজার ব্যাপার হলো, দলটি রীতিমতো শূন্য থেকে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। শুরুতে দলের সাত শিল্পীকে একটি ঘরেই ভাগাভাগি করে থাকতে হতো। কারণ, তখন তাঁদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বিগ এন্টারটেইনমেন্ট ছিল একটি ক্ষুদ্র কোম্পানি। তাই বিলাসিতার চেয়ে টিকে থাকাই সে সময় ছিল বিটিএসের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার। 

 প্রথম গান

বিটিএস যে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তা বোঝা যায় দলটির প্রথম একক গান মুক্তির দুই সপ্তাহের মধ্যেই। গানটি অল্প সময়ের মধ্যেই ‘বিলবোর্ড ওয়ার্ল্ড ডিজিটাল সং’ তালিকার ১৪ নম্বরে উঠে আসে। একই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার মেলন মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে ‘বেস্ট নিউ আর্টিস্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। 

 জনপ্রিয়তার রহস্য

২০১৪ সাল। আমেরিকান হাসেল লাইফ নামের একটি রিয়েলিটি শোতে নিজেদের এক কনসার্টের প্রচার করতে গিয়ে দর্শকদের হাতে হাতে নিজেদের পরিচিতিপত্র বিলি করতে হয়েছিল বিটিএস সদস্যদের। কিন্তু এখনকার কথা ভেবে দেখুন। ঠিক উল্টো। বিটিএসের আন্তর্জাতিক কনসার্টের টিকিট বিক্রির জন্য তোলার ৯০ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। বিটিএসের এই উত্থানের পেছনের রহস্য কী? 

বিটিএসের প্রযোজক পগ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বিটিএস সদস্যরা শিডিউলের সময় শেষ হলেও কাজ করতে থাকে। তা রাত হলেও। কেউ তাদের এতটা পরিশ্রম করতে বলে না, কিন্তু এরপরও ওরা করে। ওরা মিউজিক বানাতে পারে, কারণ ওরা তা করতে পছন্দ করে। ওরা সবাই গান ভালোবাসে। নিজেদের গল্পগুলো ওরা ফুটিয়ে তোলে গানে। ওরা সৎ, আর আমার মতে, এটাই বিটিএসকে সবার থেকে আলাদা করে রাখে। এই কারণেই ভক্তরা সহজেই বিটিএসের গানকে মনে ধারণ করতে পারেন।’ 

 বাঁক বদল

অনেক ভক্তই মনে করেন, বিটিএসের বাঁক ঘুরে যায় ২০১৫ সালে সাউথ কোরিয়ার গানের অনুষ্ঠান ‘দ্য শো’–এর মধ্য দিয়ে। সে সময় তাদের গান ‘আই নিড ইউ’ দলটিকে কেবল আকর্ষণীয় আর স্টাইলিশ হিসেবে তুলে ধরেনি, সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে পরিচিতও করে তুলতে দারুণ ভূমিকা রেখেছে। 

২০১৭ সালে বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড আসরের ‘টপ সোশ্যাল আর্টিস্ট’ পুরস্কারটি জিতে নেয় বিটিএস। সেই সঙ্গে দলটি চলে আসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজরেও। এরপর একই বছরে বিভিন্ন মার্কিন টিভি অনুষ্ঠানে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করতে শুরু করে বিটিএস। দ্য লেট লেট শো উইথ জেমস কর্ডেন, জিমি কিমেল লাইভ!, এলেন ডিজেনারেস শোতে গিয়ে কোরিয়ার সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের লাখ লাখ হৃদয় জিতে নেয় দলটি। ব্যান্ডের প্রথম মার্কিন শো ছিল ২০১৭ সালে আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে। এরপর তারা জায়গা করের নেয় ফোর্বস সাময়িকীর এশিয়ার প্রভাবশালী অনুর্ধ্ব ৩০–এর তালিকায়।

২০১৮ সালে বিটিএসই প্রথম কে পপ গ্রুপ হিসেবে বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ডের মঞ্চে গান পরিবেশন করে। কোরিয়ান পপ ব্যান্ড হয়েও বিলবোর্ড তালিকার ১ নম্বরে জায়গা করে নেওয়া, মারুন ফাইভ, কেটি পেরি, বিয়ন্সেদের মতো তাগড়া ব্যান্ড আর শিল্পীদের পেছনে ফেলা দেওয়া হয়ে ওঠে এ দলের জন্য ডাল–ভাত। 

 বিটিএস আর্মি

বিটিএসের অন্যতম শক্তি ‘আর্মি’। বিটিএসের ভক্তদের ‘আর্মি’ বলা হয়। অনেকে মনে করেন, এই ভক্তরা একটু বেশি বেশি আবেগ দেখান। কিন্তু এটা যে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, তা বোঝেন না অনেকেই। বিটিএস আর্মির অধিকাংশই তরুণ-তরুণী বা কিশোর ছেলেমেয়ে। বিটিএসের গানের বিষয়গুলো ভক্তদের মনে দাগ কাটতে পারে। কারণ, এই বয়সী ছেলেমেয়েদের যেসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়, গানগুলো সেসব কথাই বলে। সামাজিক, মানসিক স্বাস্থ্য, একক সত্তা, নিজেকে ভালোবাসা ইত্যাদি থাকে এদের গানের কথায়। এর সঙ্গে ব্যান্ড সদস্যদের চোখ ধাঁধানো কোরিওগ্রাফি তো আছেই। 

 গানের বাইরেও বিটিএস

২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিটিএস জাতিসংঘে ভাষণ দেয়। ব্যান্ডের প্রধান আরএম নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা টেনে এনে উল্লেখ করে, কীভাবে গান তাকে হাল না ছাড়ার শিক্ষা দিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রত্যেক তরুণের জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে বিটিএস কাজ করছে ইউনিসেফের সঙ্গে ‘লাভ মাইসেলফ’ নামের একটি কার্যক্রমে। এই কার্যক্রমের মূল বার্তা হচ্ছে—প্রকৃত ভালোবাসার শুরুটা যেন হয় নিজেকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া শিশু ও নারীর নিরাপত্তা নিয়েও শুরু হওয়া কর্মসূচিতেও বিটিএস ও বিটিএস আর্মির অবদান অসামান্য। 

বিভিন্ন কে পপের ব্যান্ডের প্রতি সপ্তাহ বা মাসের কার্যক্রমগুলো ভিডিও আকারে দলের নিজ নিজ প্লাটফর্মে প্রকাশ করা হয়। এর মধ্য দিয়েই ভক্তদের সঙ্গে ব্যান্ডের এক ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। অনেকটা অধীর আগ্রহে কোনো টিভি সিরিজের নতুন পর্বের জন্য দর্শক যেভাবে অপেক্ষা করে, কে পপ ভক্তরাও সেভাবে তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকেন প্রিয় দলের নতুন ভিডিও দেখার জন্য। 

 সমালোচকদের দৃষ্টিতে 

মুদ্রার এপিঠ দেখলেই হবে না, ওপিঠে কী আছে তা–ও জানা দরকার। বিটিএসের ভক্তদের দেখে অনেকেই এমনভাবে তাকান, যেন আজব কোনো প্রাণী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভক্তের ভক্তি আর সমালোচকদের যুক্তি, রীতিমতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। 

বিটিএসকে পছন্দ না করার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন, তাদের পোশাক-আশাক বা বেশভূষা। এই সাজগোজকে নেতিবাচকভাবে দেখেন কেউ কেউ। অনেক ক্ষেত্রে ট্রলেরও শিকার হতে হয় এমন সাজগোজের জন্য। অবশ্য এই উপহাসের বেশির ভাগই বাংলাদেশ-ভারত অঞ্চলের সমালোচকেরাই বেশি করে থাকেন। 

গানের ভাষা নিয়েও রয়েছে আলোচনা–সমালোচনা। কোরিয়ান ভাষার গান আমরা কীভাবে বুঝব? তবে অনেকেই আবার বলেন, গান তো গাই-ই, এটা বুঝতে কোনো ভাষা লাগে না! আরেক দল মনে করে, বিটিএসের সব গানের সারমর্ম একই রকম। এগুলোর মধ্যে এমন কোনো তফাত নেই। 

বিটিএসের গানের জন্য আরও কাজ করা উচিত, নয়ত পরিণতি ভালো হবে না বলে মনে করেন অনেক সমালোচক। এই বিটিএস–‘হাইপ’ (উত্তেজনা) নাকি কেটে যাবে। আবার নাচ নিয়েও সমান আপত্তি আছে একটি বড় অংশের। বিটিএসের নাচ এমন আহামরি কিছু নয়। তাদের চেয়ে অন্য কোরিয়ান ব্যান্ডগুলো নাচের দিক থেকে অনেক এগিয়ে আছে। আর র​্যাপের কথা তো বাদই দিলাম!

তবে সমালোচকদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন, বিটিএসের কয়টা গান শুনেছেন। ‘তেমন কোনো গান শুনিনি’—এই ধরনের উত্তরই বেশি পাবেন আশা করি। এটা তো প্রচলিতই, যাদের জনপ্রিয়তা একটু বেশি, সমালোচনাটাও তো একটু বেশিই হবে! 

মুসাব্বির হুসাইন