স্তব্ধ হলো শান্তনু বিশ্বাসের কণ্ঠ, থেমে গেল সুর

সংগীতশিল্পী ও নাট্যজন শান্তনু বিশ্বাস। ১২ জুলাই বেলা ৩টায় তিনি ঢাকায় মারা যান।
সংগীতশিল্পী ও নাট্যজন শান্তনু বিশ্বাস। ১২ জুলাই বেলা ৩টায় তিনি ঢাকায় মারা যান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বেশ সক্রিয় ছিলেন। তিন দিন আগে ৯ জুলাই ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘ভোরে দেখা স্বপ্ন যত/ সব যদি আজ সত্যি হতো/ আকাশ কি আর ঢাকতো মেঘে এমন/ সকালবেলায় রাত্রিবেলা ঘুম রেখেছো কোথায়/ ঘুম রেখেছো লুকিয়ে বুঝি তোমার চোখের পাতায়।’ এই তো গত ২৮ জুন চট্টগ্রামে কালপুরুষ নাট্য উৎসবে তাঁর লেখা ও নির্দেশনায় নাটক ‘নির্ভার’ মঞ্চস্থ হলো। সেখানে অভিনয় করেছেন তিনি। আজ শুক্রবার সেই নাট্যজন সংগীতশিল্পী শান্তনু বিশ্বাস চলে গেলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে, চির ঘুমে। স্তব্ধ হলো তাঁর কণ্ঠ, থেমে গেল সুর।

শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গেল মঙ্গলবার অসুস্থ হওয়ার পর তাঁকে চট্টগ্রামের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার ঢাকায় আনা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা। তিনি ইস্পাহানি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

কালপুরুষ নাট্য উৎসবে তাঁর লেখা ও নির্দেশনায় ‘নির্ভার’ নাটকের একটি দৃশ্যে শান্তনু বিশ্বাস
কালপুরুষ নাট্য উৎসবে তাঁর লেখা ও নির্দেশনায় ‘নির্ভার’ নাটকের একটি দৃশ্যে শান্তনু বিশ্বাস

শুক্রবার রাতেই তাঁর মরদেহ নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন পরিবারের সদস্যরা। শনিবার ১৩ জুলাই বেলা ১১টায় সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনার চত্বরে মরদেহ রাখা হবে। বিকেল ৪টায় প্রয়াত নাট্যকার, নির্দেশক , সংগীতশিল্পী ও কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা শান্তনু বিশ্বাসের মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে আনা হবে।

বহুরৈখিক নিভৃতচারী শিল্পী ছিলেন শান্তনু বিশ্বাস। জীবনকালে প্রথম আলোর কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল। তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাটক লেখা, অভিনয় ও নির্দেশনা শুরু করেন। ১৯৭৬ সালের দিকে চট্টগ্রামে শান্তনু বিশ্বাস আরও কয়েকজন নাট্যকর্মীসহ অঙ্গন থিয়েটার গড়ে তোলেন। ‘কালো গোলাপের দেশ’ তাঁর লেখা প্রথম নাটক। মঞ্চেও দেখা গেছে শুরু থেকে। ‘অঙ্গন’ এবং ‘গণায়ন’-এ অভিনয় করে তিনি ওই সময়ে সাড়া ফেলেছিলেন। তিনি নাটকের নির্দেশনা আবহও তৈরি করেন তৃতীয় নাটক ‘নবজন্ম’-তে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা তাঁর নাটক ‘ইনফরমার’ ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়।

পশ্চিমবঙ্গের কবি জয় গোস্বামীর সঙ্গে শান্তনু বিশ্বাস ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।
পশ্চিমবঙ্গের কবি জয় গোস্বামীর সঙ্গে শান্তনু বিশ্বাস ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।

মৌলিক নাটকের পাশাপাশি অনুবাদ বা রূপান্তরেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। লিখতেন গানও। কবি মনিরুল মনিরের খড়িমাটি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় শান্তনু বিশ্বাসের গানের বই ‘গানের কবিতা- খোলাপিঠ’। ২০০৭ সালে শান্তনু বিশ্বাসের কথা ও সুরে এটিএন মিউজিক থেকে একটি সংকলন বের হয় যেটিতে কণ্ঠ দেন শিল্পী সুবীর নন্দী ও কলকাতার ইন্দ্রাণী সেন। ২০০৮ সালে ইমপ্রেস অডিও ভিশন থেকে শান্তনুর লেখা সুরে শিল্পী অরুনিমা ইসলাম ও নিজের গাওয়া যৌথ সংকলন বের হয়। ২০০৯ সালে জি সিরিজের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান অগ্নিবীণা বের করে শান্তনু ও শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের যৌথ অ্যালবাম। ২০১২ সালে বের হয় একক সংকলন ‘পোস্টম্যান’ ও ২০১৪ তে ‘খড়কুটো’।

শান্তনু বিশ্বাস সংগীতের সংগঠকও। এ বিষয়ে তিনি গবেষণা করেছেন, প্রবন্ধও লিখেছেন। কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়ের উপদেষ্টা শান্তনু বিশ্বাস নিজের রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় নিয়ে সবশেষ মঞ্চে ওঠেন ২৮ জুন, এ নাটকে তিনি অভিনয়ও করেন।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে কালপুরুষ নাট্য উৎসবে শান্তনু বিশ্বাস ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে কালপুরুষ নাট্য উৎসবে শান্তনু বিশ্বাস ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।

বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ, কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, নাট্যাভিনেতা, সুরকার, গীতিকার ও সংগীতশিল্পী শান্তনু বিশ্বাসের আকস্মিক প্রয়াণে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের (চট্টগ্রাম বিভাগ) সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোসলেম উদ্দীন সিকদার ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল আলম এবং চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটার ফোরামের সভাপতি খালেদ হেলাল ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ শাহ্ আলম গভীর শোক প্রকাশ করেছে। শান্তনু বিশ্বাসের অকাল প্রয়াণে নাট্যাঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।