মেরাজ ফকিরের মা'র ২০০ পূর্ণ

মেরাজ ফকিরে মা নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: ছবি হাসান রাজা
মেরাজ ফকিরে মা নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: ছবি হাসান রাজা

এক সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবদুল্লাহ আল-মামুন ১৯৯৫ সালে লিখেছিলেন মঞ্চ নাটক ‘মেরাজ ফকিরের মা’। ২৪ বছর পর আজ শনিবার সন্ধ্যায় নাটকটি ২০০তম প্রদর্শনী হয় জাতীয় নাট্যশালায়।

প্রয়াত নাট্যকার আব্দুল্লাহ আল-মামুনের ৭৭তম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে নাটকের দল থিয়েটার ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যৌথভাবে দুই দিনব্যাপী ‘আব্দুল্লাহ আল-মামুন-এর ৭৭ তম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন’ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। জাতীয় নাট্যশালায় শুক্র ও শনিবার দুই দিন আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে থিয়েটার-এর প্রতিষ্ঠাতা এই নাট্যজনকে স্মরণ করা হয়। নাট্যব্যক্তিত্বের জন্মদিনকে আরও স্মরণীয় করতে থিয়েটার তাঁর রচিত ও নির্দেশিত বিখ্যাত নাটক ‘মেরাজ ফকিরের মা’-এর ২০০তম প্রদর্শনীরও আয়োজন করে।

গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫টা ও সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মেরাজ ফকিরের মা নাটকের ১৯৮ ও ১৯৯তম প্রদর্শনী হয়। আজ শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে ‘বর্তমান প্রেক্ষিতে নাট্য প্রযোজনা ও অভিনয়’ শীর্ষক আব্দুল্লাহ আল-মামুন স্মারক বক্তৃতা দেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হয় মেরাজ ফকিরের মা নাটকের ২০০তম প্রদর্শনী। এদিন ২০০টি প্রদর্শনীতে টানা অভিনয়ের জন্য থিয়েটার নাটকটির তিনজন অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার এবং মারুফ কবিরকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করে।

শনিবার নাটকটির ২০০তম প্রদর্শনী হয়। ছবি: হাসান রাজা
শনিবার নাটকটির ২০০তম প্রদর্শনী হয়। ছবি: হাসান রাজা

দুই দিনে মেরাজ ফকিরের মা নাটকের তিন প্রদর্শনীতে উল্লেখযোগ্য দর্শকের উপস্থিতি ছিল। দর্শক এবং অতিথিরা মনে করেন, ২৪ বছরের পুরোনো নাটক হলেও নাটকের গল্পটি সমসাময়িক মনে হয়েছে। কেননা, ২৪ বছর পরও এই দেশে নারীকে নানা অজুহাতে নির্যাতন করা হয়। তার অর্থ হচ্ছে, দুই যুগ পরও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে, মেরাজ বা গেদা ফকিরদের মতো ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রভাব আরও বিস্তৃত হয়েছে সমাজের ওপর। তার প্রতিফলন গ্রাম-শহর সর্বত্রই প্রতিনিয়ত দেখা যায়।

কোনো একসময়ের যাত্রার দলের অভিনেতা মোজাহের মল্ল, ভুলতে পারে না তার অতীত স্বভাব। তাই ৩৯ বছর পরও তার কথা ও চলনে থাকে যাত্রাপালার ডায়ালগ ও গান। গাইতে থাকে ‘নিশিথে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা’ গানটি। নিজের স্ত্রী আলো বিবির সঙ্গে যাত্রাপালার ঢঙে কথাবার্তা দিয়েই শুরু হয় নাটক মেরাজ ফকিরের মা।

নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার ছবি: প্রথম আলো
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার ছবি: প্রথম আলো

নাটকের কাহিনি গড়ে উঠেছে ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করে। জন্মের ৩৯ বছর পর আকস্মিকভাবে সে জানতে পারে তার গর্ভধারিণী মায়ের ধর্ম আর তার ধর্ম এক নয়। ধর্ম পরিচয়ে যে ফারাক রচিত হয় তা কি মা-ছেলের সম্পর্ককে ফারাক করে দিতে পারে? ধর্মের ভিন্নতার কারণে ছেলে কি অস্বীকার করতে পারে তার মাকে? মানবিক সম্পর্ক আর বাহ্যিক আচার সর্বস্ব সম্পর্ক—দুইয়ের মধ্যে কোনটির সঙ্গে রয়েছে নাড়িছেঁড়া টান? এমনি সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং মানবের স্বরূপ প্রকাশের চেষ্টা হয়েছে নাটকটিতে।

এভাবেই নাটকের কাহিনি আবর্তিত হয়। নাটকে উঠে এসেছে আজকের বাংলাদেশের ঘটমান কিছু বাস্তবতা। ধর্ম ব্যবসাকে পুঁজি করে, ধর্মের অপব্যাখ্যা করে এক শ্রেণির স্বার্থলোভী অসৎ মানুষ সমাজের প্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখার যে অপচেষ্টা চালাচ্ছে দেশজুড়ে, তার প্রতিও বিশেষভাবে আলো ফেলা হয়েছে এ নাটকে।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
আবদুল্লাহ আল-মামুন

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার, ত্রপা মজুমদার, তোফা হোসেন, মারুফ কবির, রাশেদুল আওয়াল, তামান্না ইসলাম, সাইফ জোয়ারদার, নুরুল ইসলাম, এরশাদ হাসান, খুরশীদ আলম, আপন আহসান, অলিউল হক, রবিন বসাক, পরেশ আচার্য্য, তানভীর সামদানী, আতিকুর রহমান, কাওসার রাজীব প্রমুখ।
অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক, চলচ্চিত্র পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-মামুনের ৭৭তম জন্মদিন আজ ১৩ জুলাই। ১৯৪২ সালের ১৩ জুলাই জামালপুরের আমড়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতা অধ্যক্ষ আব্দুল কুদ্দুস এবং মাতা ফাতেমা খাতুন। তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে এম এ পাস করেন। আব্দুল্লাহ আল–মামুন তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে। পরবর্তীকালে পরিচালক, ফিল্ম ও ভিডিও ইউনিট (১৯৬৬-১৯৯১), মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমি (২০০১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

অসংখ্য নাটক রচনায় যেমন নিজের প্রতিভা আর শক্তির পরিচয় দিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন, তেমনি নিজের অপরিমেয় ক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন তাঁর নির্দেশনায় ও অভিনয়েও৷ তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখন দুঃসময়’, ‘সেনাপতি’, ‘এখনো ক্রীতদাস’, ‘কোকিলারা’, ‘দ্যাশের মানুষ’, ‘মেহেরজান আরেকবার’ ও ‘মেরাজ ফকিরের মা’ ইত্যাদি।