নগরের মঞ্চে পাড়াগাঁয়ের 'ধামাইল'

শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার পরিবেশিত ধামাইল নৃত্যর একটি দৃশ্য ছবি: প্রথম আলো
শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার পরিবেশিত ধামাইল নৃত্যর একটি দৃশ্য ছবি: প্রথম আলো

ব্যতিক্রম এ আয়োজন, পরিবেশনা। যেখানে শিল্পীরা ছন্দোবদ্ধ করতালির মাধ্যমে গানের তাল-লয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। শুরুতে একজন গান ধরেন। একজন একটি চরণ গাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সবাই সম্মিলিতভাবে করতালি দিয়ে কণ্ঠ মেলান এবং বৃত্তাকারে ঘোরেন। 

সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল নৃত্যর দেখা মিলল আজ সন্ধ্যায়, শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ধামাইল কর্মশালায় অংশ নেওয়া শিল্পীরা মেলে ধরলেন সেই পরিবেশনা। আজ রোববার সন্ধ্যায় তাঁদের এ আয়োজনটি দেখে অনেক দর্শক স্মৃতিকাতর হন, যেন পাড়াগাঁয়ের উঠানের খোলা জায়গায় হচ্ছে নাচগানের পালা। রাধাকৃষ্ণের কাহিনিভিত্তিক লোকজ এই ধামাইল সংগীতের জনক রাধারমণ দত্ত।

সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী
সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী

সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল গান ও নৃত্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। একাডেমির ৩০ জন সংগীত ও নৃত্যশিল্পীর অংশগ্রহণে তিন দিনব্যাপী এই কর্মশালা শুরু হয় ১২ জুলাই সকাল ১০টায়। শিল্পীদের ধামাইল গানে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সুনামগঞ্জের সংগীত প্রশিক্ষক দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন। নৃত্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তুলিকা ঘোষ চৌধুরী। আজ ছিল সমাপনী আয়োজন। এতে প্রশিক্ষণার্থীদের অংশগ্রহণে সাতটি গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশিত হয়। এর মধ্যে আসন বন্দনায় গীত হয় ‘তোমরা আসন সাজাওগো’, বিচ্ছেদ বন্দনায় ‘আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখবার মনে লয়’, বাঁশি পর্বে ‘বাঁশিত ধইরা মারলো টান’ ও ‘বাইজ্জোনারে শ্যামের বাঁশি জয় রাধা বলিয়া’, আক্ষেপ পর্বে ‘আমি সাধ করে পরেছি গলে শ্যাম কলঙ্কের মালা’, জলভরা পর্বে ‘আমি কি হেরিলাম জলের ঘাটে গিয়া সখী গো’ এবং সবশেষে মিলন পর্বে পরিবেশিত হয় ‘যুগল মিলন হইলো গো বৃন্দাবন আজ প্রেমে ভাইসা যায়’ গানটি।

ধামাইল কর্মশালায় অংশ নেওয়া শিল্পীরা অংশ নেন নৃত্য পরিবেশনায়।
ধামাইল কর্মশালায় অংশ নেওয়া শিল্পীরা অংশ নেন নৃত্য পরিবেশনায়।

সমাপনী আয়োজনে শুভেচ্ছা বক্তব্যে প্রশিক্ষক তুলিকা ঘোষ চৌধুরী বলেন, ‘এখন আমরা একটা স্মার্ট যুগে চলে এসেছি। আমাদের যে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবেশনাগুলো কোনো নির্দিষ্ট সংস্কৃতি বা জাতির নয়। তাই আমরা সবাই মিলে সেটি করতে পারি। ধামাইল সাধারণত নারীরা করে থাকে কিন্তু আমি চাই, নারী-পুরুষ বৈষম্য না করে সবাই একযোগে কাজ করবো। তাই এই প্রশিক্ষণে পুরুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে।’ 

তুলিকা ঘোষ চৌধুরী জানান, ধামাইলের পরিবেশনায় রয়েছে বেশ কয়েকটি পর্ব। এর মধ্যে তিন দিনে পাঁচটি পর্বের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ধামাইলে পর্ব অনুযায়ী পোশাকের ভিন্নতা বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয় শিল্পীদের। ধামাইল মূলত নারীরা পরিবেশন করে থাকেন দলগতভাবে।

বাংলাদেশে যে এতগুলো ঐতিহ্যবাহী লোকজ নাচের ধরন আছে তা অনেকেই জানেন না। তাই লোকজ উৎস ও প্রশিক্ষণ থেকে এ রকম নাচের ধরন শেখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন প্রশিক্ষণার্থীরা। বিভিন্ন লোকজ গান ও নৃত্যের প্রশিক্ষণ আয়োজন এবং ধামাইল উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।

দেশের হাওরাঞ্চলে প্রচলিত এমনই একটি লৌকিক আচার বা অনুষ্ঠানের নাম ‘ধামাইল গান’।
দেশের হাওরাঞ্চলে প্রচলিত এমনই একটি লৌকিক আচার বা অনুষ্ঠানের নাম ‘ধামাইল গান’।

দেশের হাওরাঞ্চলে প্রচলিত একটি লৌকিক আচার বা অনুষ্ঠানের নাম ‘ধামাইল গান’। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বৃহত্তর সিলেটের হাওরবেষ্টিত কিছু কিছু এলাকায় হিন্দু বিয়ের ক্ষেত্রে এটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। এসব এলাকার গ্রামীণ নারীদের ধামাইল গান বা নৃত্য ছাড়া বিয়ের আনন্দই পূর্ণ হয় না। আর তাই কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুগ যুগ ধরে এ গানের চর্চা করে আসছেন তাঁরা। সাধারণত বিয়ের জলভরা, যাত্রা বা দ্বিরাগমনের সময় ধামাইল গানের আয়োজন করা হয়। গানের আগে নারীরা নদী বা পুকুর থেকে কলসি ভরে জল আনেন। এরপর বর বা কনেকে পরিবেশন স্থানের মাঝখানে চেয়ার বা পিঁড়িতে বসিয়ে তাঁদের সামনে পানিভর্তি কলস সাজিয়ে রাখেন। কলসি ছাড়াও উপকরণ হিসেবে থাকে লুঙ্গি, গামছা, সাবান, সিঁদুর, ধান, দুর্বা, কুলা, ফুল, প্রদীপ প্রভৃতি। গায়িকারা বর-কনের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে গান পরিবেশন করেন। এ ধরনের গানে সাধারণত বর-কনের বৌদি, বোন, বিয়ান, ঠাকুরমা, দিদিমা প্রভৃতি সম্পর্কের (যাঁদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা চলে) আত্মীয়স্বজনেরাই অঙ্ক নিয়ে থাকে। গান শেষে কলসির পানি দিয়ে বর-কনে ও বরের ভগ্নিপতিকে স্নান করানো হয়। স্নানের পর তাঁদের জামা বা প্যান্টের কাপড়, গেঞ্জি, লুঙ্গি প্রভৃতি উপহার দেওয়া হয়।