দুই অভিনেত্রীর মঞ্চযাত্রা

দুই গুণী অভিনেত্রী সারা যাকের ও শিমূল ইউসুফ নিজেদের মঞ্চাভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা বললেন। গতকাল রাজধানীর মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে।  ছবি: আশরাফুল আলম
দুই গুণী অভিনেত্রী সারা যাকের ও শিমূল ইউসুফ নিজেদের মঞ্চাভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা বললেন। গতকাল রাজধানীর মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে। ছবি: আশরাফুল আলম

ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছেন সারা যাকের। বাংলাটা তাঁর ভালো নয়। চাচা পরামর্শ দিলেন, নাটকের দলে যুক্ত হও। সারা যাকেরের শুরু হলো মঞ্চযাত্রা। আর সারা যাকের ও ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয় দেখে থিয়েটারে আগ্রহী হয়েছিলেন শিমূল ইউসুফ। বাংলা মঞ্চনাটকে যাঁদের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন দর্শক, তরুণেরা স্বপ্ন দেখেন অভিনয়শিল্পী হওয়ার, তাঁদের অন্যতম এই দুজন—সারা যাকের ও শিমূল ইউসুফ। বললেন নিজেদের মঞ্চযাত্রার গল্প।

গতকাল শুক্রবার সকালে ভরে উঠেছিল রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তন। থিয়েটার ডিরেক্টরস ইউনিটি বাংলাদেশের সমন্বয়কারী অনন্ত হিরা শুভেচ্ছা জানিয়ে মঞ্চে আহ্বান করেন দুই নন্দিত অভিনয়শিল্পীকে। নির্দেশক ও অভিনেতা আজাদ আবুল কালামের সঞ্চালনায় শুরু হয় আলাপন।

শিমূল ইউসুফ বলেন, ‘তিয়াত্তর সালে সৎ মানুষের খোঁজে নাটকে সারা ভাবির অভিনয় দেখি। তারপর আমি থিয়েটারে আসি। তার আগে দেখেছি ফেরদৌসী আপার এখনও দুঃসময় নাটকটি। এই দুজনের অভিনয় দেখে সিদ্ধান্ত নিই, আমি অভিনয় করব। আমি সংগীতচর্চা করেছি, রেডিও–টেলিভিশনে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। যদি বলি কার পথ ধরে মঞ্চে এসেছি, তাঁরা দুজন—ফেরদৌসী মজুমদার ও সারা যাকের। পরে গান ছেড়েই দিলাম। মঞ্চের এমন নেশায় আমাকে পেয়ে গেল যে সে নেশাতেই ডুবে গেলাম।’

মঞ্চনাটক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল। এই দুই অভিনয়শিল্পীরও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যোগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিমূল ইউসুফের বয়স ১৪ বছর। তাঁর সামনেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ভগ্নিপতি শহীদ আলতাফ মাহমুদকে। সেই দিনগুলোর স্মৃতিও মনে করলেন তিনি। বললেন, ‘আলতাফ মাহমুদ আমার গুরু। তাঁর কাছে আমি গান শিখেছি। পাকিস্তানি আর্মিরা তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার চোখে চোখ রাখলেন তিনি, যাকে বলে অন্তর্দৃষ্টি। ওই দিন চার সেকেন্ডে আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়ে গিয়েছিল। আজ এত বছর পরে ভাবছি, ভাইয়া আমাকে বলতে চেয়েছিলেন, তোমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেলাম, পালন কোরো। না হলে আমি কেন সংগীত ছেড়ে দিয়ে থিয়েটার করব। চুয়াত্তরে ঢাকা থিয়েটারে যোগ দিই। তখন মনে হয়েছিল, একদল মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা থিয়েটারে। আমার জায়গা এটাই। যেহেতু যুদ্ধ করতে পারিনি, ছোট ছিলাম, সেহেতু যুদ্ধটা মঞ্চেই করি।’

সঞ্চালক আজাদ আবুল কালাম বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তাঁদের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটেছিল। যা তাঁদের শিল্পীজীবনে নিশ্চিতভাবে প্রভাব ফেলেছে। একইভাবে সারা যাকেরের জীবনেও হারানোর দুঃখ আছে।’ সারা যাকের জানালেন, ‘আমার ভাইয়ের বয়স তখন কুড়ি বছর। সে যুদ্ধে চলে গেল। আর ফিরে আসেনি। আমি যখন মঞ্চে যোগ দিই, তখন এটাই ভেবেছি—সে অভিনয় করত, দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিল, আমি অভিনয় দিয়েই দেশের জন্য কিছু করব। আমাদের সবার কথা শুনলেই মনে হবে, সেই সময় আমরা যারা থিয়েটার শুরু করেছিলাম, সবার সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের যোগ ছিল।’

দুজনের আলাপনে উঠে আসে থিয়েটারে নারী অভিনয়শিল্পীদের পথচলায় সংকট-সম্ভাবনা। আলাপন শেষে তাঁদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন তরুণ মঞ্চকর্মীরা। জেনে নেন থিয়েটারচর্চার নানা দিক। এই আয়োজনের ইতি টানেন থিয়েটার ডিরেক্টরস ইউনিটি বাংলাদেশের সদস্য মলয় ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘এই দুজনের মঞ্চ অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমরা ঋদ্ধ হলাম।’

থিয়েটার ডিরেক্টরস ইউনিটি বাংলাদেশ এই আয়োজন করে ‘তিন প্রজন্মের নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যজন ও দর্শকের মুখোমুখি’ শিরোনামে। এর আগে এই আয়োজনে অতিথি ছিলেন মামুনুর রশীদ ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ।