কমল দাশগুপ্ত এসেছিলেন শ্রাবণে, শ্রাবণেই বিদায়

আট হাজার গানের সুর করেছেন কমল দাশগুপ্ত
আট হাজার গানের সুর করেছেন কমল দাশগুপ্ত

‘সৎ পাত্রে কন্যা দান করলে বাবা যেমন নিশ্চিন্তে থাকেন, তেমনি নিশ্চিন্ত থাকতেন কাজী নজরুল ইসলাম সুরকার কমল দাশগুপ্তকে গান সুর করতে দিয়ে।’ উপমহাদেশের অন্যতম গুণী সুরকার, সংগীতজ্ঞ কমল দাশগুপ্ত প্রসঙ্গে এমনটাই মন্তব্য করেছেন নজরুল বিশেষজ্ঞরা। এমনকি প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমও জীবনকালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেছিলেন। আজ উপমহাদেশের গুণী এই সুরকারের ৪৫তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই ৬২ বছর বয়সে নীরবে বিদায় নেন এই সংগীত ব্যক্তিত্ব।

ছেলে শাফিন আহমেদসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন কমল দাশগুপ্তকে। ‘পৃথিবী আমারে চায়’-এর মতো জনপ্রিয় আধুনিক গানসহ প্রায় আট হাজার গানের সুর করেছেন কমল দাশগুপ্ত। যার মধ্যে ছিল আধুনিক, নজরুলসংগীত, ভজন, গীত, গজল, কাওয়ালি ইত্যাদি। ৩০ বছর তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে প্রধান সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। ৮০টি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি ছবিতে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালনার পুরস্কার পেয়েছেন।

তৎকালীন নড়াইল জেলার কালিয়া জনপদের বেন্দা গ্রামে ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই কমল দাশগুপ্তের জন্ম। কাকতালীয়ভাবে ২৮ জুলাই তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগমেরও জন্ম, ১৯৩০ সালে। শৈশব কেটেছে যশোরে, কৈশোরের কিছুদিন কেটেছে কোচবিহারে। তাঁর পরিবারের উপার্জনের উৎস ছিল গুপ্ত প্রেস। আর্থিক কষ্ট তাঁর ছিল না। এরপরই তাঁর পরিবার চলে যায় কলকাতায়। কলকাতার মানিকতলার একটি বাড়িতে তাঁরা থাকতে শুরু করেন। নিচে ছিল প্রেস। নয় ভাইবোনের সবাই ছিলেন সংগীতের সঙ্গে যুক্ত। সবার রেকর্ড বেরিয়েছিল এইচএমভি কোম্পানি থেকে। বাড়িতেই সংগীতের ভিত্তিটা হয়েছিল তাঁর। সেই সময় বাড়িতে বিখ্যাত সব ওস্তাদের আনাগোনা ছিল। কাজী নজরুল ইসলামও তাঁদের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন।

বিয়ের পর সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে কমল দাশগুপ্ত
বিয়ের পর সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে কমল দাশগুপ্ত

পরবর্তী সময়ে তিনি ও কাজী নজরুল ইসলাম একই সঙ্গে গ্রামোফোন কোম্পানির প্রশিক্ষক ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছ থেকে সংগীতে তালিম নেন। জমিরউদ্দীন খাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর কাছেই তালিম নেন কমল দাশগুপ্ত। তিনি ও তাঁর ভাই সুবল দাশগুপ্ত অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে প্রথম হয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও গান শুনিয়েছেন। তাঁরা দুই ভাই কমল দাশগুপ্ত ও সুবল দাশগুপ্ত রেডিওতে ‘চাঁদ-সুরুজ’ নামে কাওয়ালি গাইতেন। তাঁর আরেক বোন সুধীরা সেনগুপ্ত ছিলেন নজরুলসংগীতের শিল্পী।

তাঁর গানে বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ ছিল পরিমিত। কমল দাশগুপ্তকে নিয়ে নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আধুনিক বাংলা গানের যে ধারা আমরা দেখি, তা মূলত প্রেমের গান। নজরুল তাঁর প্রথম দিকের গানে নিজে সুর করেছেন। পরের দিকে হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি) রেকর্ড থেকে তিনি তরুণ প্রতিভাবান সুরকারদের সুর করতে দিতেন। তার মধ্যে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন। এমন সাংগীতিক প্রতিভা বাংলা গানে বিরল।’

কমল দাশগুপ্তর সুর করা অনেক গানের মধ্যে অন্যতম ‘আমি ভোরের যূথিকা’, ‘সাঁঝের তারকা আমি’, ‘শতেক বরষ পরে’, ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’, ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’, ‘আমি ভুলে গেছি তব পরিচয়’, ‘তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘আমার দেশে ফুরিয়ে গেছে ফাগুন’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘যেথা গান থেমে যায়’, ‘কথার কুসুমে গাঁথা’, ‘মোর হাতে ছিল বাঁশি’, ‘তোমার জীবন হতে’, ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের দেশে’ ইত্যাদি। এ ছাড়া তাঁর সুরারোপিত শ্রেষ্ঠ বাংলা গান: ‘এই কি গো শেষ দান’, ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে’, ‘চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়’, ‘দুটি পাখি দুটি নীড়ে’, ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়’, ‘আমার যাবার সময় হলো’, ‘তুমি হাতখানি যবে রাখ মোর হাতের ‘পরে’, ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে’, ‘আমি বনফুল গো’ ইত্যাদি। তাঁর স্বকণ্ঠে গাওয়া ‘আজো কাঁদে কাননে’, ‘জগতের নাথ কর পার’ অসাধারণ গান।

কমল দাশগুপ্ত (২৮ জুলাই ১৯১২-২০ জুলাই ১৯৭৪)
কমল দাশগুপ্ত (২৮ জুলাই ১৯১২-২০ জুলাই ১৯৭৪)

১৯৮৪ সালে মান্না দে কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রণব রায় ও সুবোধ পুরকায়স্থের কথায় যথাক্রমে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ‘কত দিন দেখিনি তোমায়’ ও ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’ গান দুটিতে। তিনি সুর সৃষ্টির পাশাপাশি বেশ কিছু গান রচনা করেন। তার মধ্যে ‘মম যৌবন সাথি বুঝি এল’, ‘বিফলে যামিনী যায়’, ‘কে আজি দিল দোলা’ গান তিনটি সুরারোপ করে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ডও করা হয়।

তিনি চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীতের পরিচালনা করেছেন। চলচ্চিত্রে নেপথ্যে সংগীত করেছেন। ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে অশোক কুমার ও কানন দেবী গেয়েছিলেন ‘অনাদিকালের স্রোতে ভাসা মোরা দুটি প্রাণ’। আর কানন দেবীকে দিয়ে গাইছিলেন ‘শেষ উত্তর’–এ ‘আমি বনফুল গো’। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কমল দাশগুপ্তও সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পীদের মধ্যে এ টি কানন, বোম্বের অভিনেত্রী শান্তা আপ্তেকে দিয়ে ইংরেজিতে বাংলা উচ্চারণ লিখিয়ে গাইয়েছিলেন ‘মোর না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা’।

প্রণব রায়ের লেখা আর কমল দাশগুপ্তর সংগীত পরিচালনায় ফিরোজা বেগমের ‘স্মৃতির মালিকা গাঁথি’ রেকর্ডের প্রচ্ছদ
প্রণব রায়ের লেখা আর কমল দাশগুপ্তর সংগীত পরিচালনায় ফিরোজা বেগমের ‘স্মৃতির মালিকা গাঁথি’ রেকর্ডের প্রচ্ছদ

সংগীতগুণী ফিরোজা বেগমের মতে, কমল দাশগুপ্তের হাতে সেই সময়ের জনপ্রিয় সব শিল্পী তৈরি হয়েছিলেন। প্রখ্যাত শিল্পী যূথিকা রায়কে নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। জগন্ময় মিত্র, অণিমা ঘোষাল, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, সুপ্রভা সরকার, আব্বাসউদ্দীন আহমদ তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তালাত মাহমুদকে দিয়ে বাংলা গান করিয়েছিলেন তিনি। এম এইচ শুভলক্ষ্মীকে দিয়ে মীরার ভজন করিয়েছিলেন। তাঁর নিজের গাওয়া নজরুলের ‘আজো কাঁদে কাননে’, ‘কত দিন দেখিনি তোমায়’, ‘জগতের নাথ করো পার’ অসাধারণ গাওয়া ছিল।

জানা যায়, ১৯৪৬ সালে ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। সে সময় গাড়ি ছাড়া চলতেন না, সেই কমল দাশগুপ্ত পারিবারিক সংকট ও নাথ ব্যাংকে দেউলিয়া হয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে পড়েন। আর্থিক ও মানসিকভাবে কমল দাশগুপ্ত যখন সর্বহারা ও বিপর্যস্ত, তখন ফরিদপুরের মেয়ে ফিরোজা বেগম তাঁর হাত ধরে শুধু জাগিয়ে তোলেননি, জড়িয়ে নেন নিজের জীবনের সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে যখন কমল-ফিরোজার বিয়ে হয়, তখন কমল দাশগুপ্তর বয়স ছিল ৪৩ বছর। বিয়ের চার বছর পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর নাম হয় কাজি কামাল উদ্দিন। কলকাতায় তাঁদের সন্তান তাহসীন, হামিন ও শাফিনের জন্ম হয়। ১৯৬৭ সালে তাঁরা ঢাকায় চলে আসেন (অবশ্য মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলার লেখায় আগমনের সময় উল্লেখ করেছেন ১৯৬৫ সাল)। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর তাঁর কোনো জায়গা হলো না যেন। ‘কমল দাশগুপ্ত: হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে’ শীর্ষক এ লেখায় আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘একদিকে কলকাতা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ঢাকাও তাঁকে গ্রহণ করেনি। সেই সময় সরকারও তাঁর প্রতি প্রসন্ন ছিল না। কোনো প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসেনি তাঁর মেধা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্য। আমাদের লজ্জা ও দায় এই যে, কমল দাশগুপ্তকে জীবিকার জন্য শেষজীবনে ঢাকায় একটা মুদিখানার দোকান খুলতে হয়েছিল।’

তথ্যসূত্র: বাংলা পিডিয়া, বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান, গোলাম মুরশিদের ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’