কে-পপ তারকা হওয়ার মূল্য কত?

বিটিএস ব্যান্ডের সদস্যরা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে দলটি
বিটিএস ব্যান্ডের সদস্যরা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে দলটি

পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত প্রসারিত হওয়া ঘরানা কে–পপ (কোরিয়ান পপ)। আমরা কয়েক সংখ্যা ধরে এই কে–পপ নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছি। কিন্তু আজ জানব এই কে–পপ তারকা হওয়া আদতে কতটা কঠিন, কতটা কাঠখড় পুড়িয়ে গান আর নাচ জানা কোরীয় শিল্পীরা হয়ে ওঠেন প্রজন্মের তারকা। আবার কতটা সহজেই তাঁরা হারিয়ে যান জনপ্রিয়তার ভিড়ে। এই কে–পপ তারকা হওয়ার মূল্য কতটা পরিশোধ করতে হয় শিল্পীদের, এই প্রতিবেদনে থাকছে সেসব কথা।

বিটিএস আমেরিকায় ঝড় তুলছে ঠিকই। কিন্তু দলটির এ পর্যন্ত আসার পথটা মোটেও সহজ ছিল না। কে–পপ দিয়ে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে যেমন শারীরিক পরিশ্রম লাগে, তেমন মানসিক ধকলও আছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় তরুণদের পপ আইডল হতে চাওয়া আর যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া একই কথা। এই যুদ্ধে নেমে অনেকেই শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেন না। তাঁরাই টিকে থাকেন, যাঁরা নিজেকে সর্বোচ্চ কষ্ট দিয়ে হলেও সফলতার চূড়ায় পৌঁছাতে চান।

প্রশিক্ষণের শুরু শৈশব থেকে

দক্ষিণ কোরিয়ার পপ ইন্ডাস্ট্রি চেষ্টা করে উঠতি প্রতিভা খুঁজে নিতে। এ জন্য বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও নির্বাহীদের সামনে অডিশন দিতে হয় আগে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তারা রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ান আগামী দিনের তারকা খোঁজার জন্য। এরপর কোনো তরুণ আনকোরা প্রতিভা পেলে তাঁর সঙ্গে লম্বা সময়ের জন্য চুক্তি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। শুরু হয় সেই কঠোর প্রশিক্ষণ।

কে–পপের বাজারে মেধার পাশাপাশি সুন্দর চেহারারও কদর অনেক। শিল্পীদের কাছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনেক। সর্বোচ্চ মুনাফা আদায়ের জন্য শিল্পীকে সর্বোচ্চ চাপ দিতেও দ্বিধা নেই তাদের। তাই প্রশিক্ষণের সময় শিল্পীদের যে চাপে রাখা হয়, তাকে অমানবিক বললেও খুব একটা ভুল হবে না। একই সঙ্গে শিল্পীদের শেখানো হয় গান, র‌্যাপ, নাচ—সব। এর পাশাপাশি চলে অভিনয়, ব্যক্তিত্ব উন্নতকরণ আর বিদেশি ভাষা শেখার ক্লাস। সেই ক্লাসের ফাঁকে শিল্পীদের উন্নতির মূল্যায়ন করা হয় প্রতিদিন। যাঁদের ক্লাসে উন্নতি হয় না বাদ পড়ে যান তাঁরা, শেষ হয়ে যায় তারকা হওয়ার স্বপ্ন। অনেকের বেলায় এই প্রশিক্ষণ ১০ বছরের জন্যও চলে।

বাহ্যিক সৌন্দর্য, সুন্দর কণ্ঠ ও শারীরিক পরিবর্তন

দক্ষিণ কোরিয়া ‘হাই বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’–এর জন্য পরিচিত। একটি ব্যান্ডের হয়ে মঞ্চে অভিষেকের আগে একজন তরুণ শিল্পীকে তাঁর চেহারা আর গড়ন ‘ফিক্স’ করতে হয়! অর্থাৎ নাক, মুখ ও চোয়ালে প্লাস্টিক সার্জনরা ছুরি চালান।

স্বাধীনতা

কে–পপ তারকা হওয়া মানে একজনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়া। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এমনভাবে একটি ব্যান্ডের বেড়ে ওঠার পরিকল্পনা করেন, যেন ব্যান্ড সদস্যরা অভিষেকের পর থেকে রাতারাতি খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। খ্যাতির এই যাত্রা একবার শুরু হয়ে গেলে, আর কোনোভাবেই শিল্পীর কোনো চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। দর্শক–শ্রোতা যা চায়, আর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের লাভ যেখানে, শিল্পীকে সেভাবেই চলতে হয়।

কে–পপ তারকা হিও চ্যানকে তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চুলের রং বদলানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু চ্যান প্রতিবাদ করে বসেন। কারণ বারবার চুলের রং বদলানো তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক ছিল। কিন্তু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কোনো প্রতিবাদ শোনেনি, বরং দল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয় চ্যানকে। তাই যন্ত্রণা সহ্য করেই নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য চুলের রং বদলাতে হয় তাঁকে।

অর্থ সমস্যা

আন্তর্জাতিক সংগীতবাজারে এখন আয়ে শীর্ষে বিটিএস—তা বলতে খুব একটা হয়তো হিসাব কষতে হয় না। তবে এমন অনেক কে–পপ দল আছে, যাদের অর্থের জন্য প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়। কারণ, অভিষেকের আগেই তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রচারণা বাবদ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ বিনিয়োগ করে, সেই বিনিয়োগের অর্থ শোধ করতে করতেই শিল্পীদের সব সৃজনশীলতা ফুরিয়ে যায়। রীতিমতো গায়ের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে হলেও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ পরিশোধের জন্য নেচে আর গেয়ে যেতে হয় কে–পপ তারকাদের।

আনন্দ প্রতিবেদক

বিবিসি ও ফোর্বস অবলম্বনে