কেমন আছেন নোবেল


ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি বাংলার সংগীতবিষয়ক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান সারেগামাপা। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিযোগী মাঈনুল আহসান নোবেল লড়াই করেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সারেগামাপা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল নোবেলের কারণেই। গত ২৮ জুলাই জানা যায় চূড়ান্ত ফলাফল। নোবেল তৃতীয় হন। তাঁর নিজের কোনো প্রত্যাশা না থাকলেও বাংলাদেশের শ্রোতারা প্রত্যাশা করেছিলেন নোবেলের হাতেই উঠুক শীর্ষ বিজয়ীর পদক। প্রত্যাশা পূরণ হয়নি তাতে কী, দেশের মানুষের হৃদয়ে প্রথম স্থানেই আছেন তরুণ এই সংগীতশিল্পী। কলকাতা থেকে ফিরে এখন ব্যস্ত নানা অনুষ্ঠান নিয়ে। নোবেলের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন শফিক আল মামুন


ব্যস্ত সময়...
সারেগামাপা প্রতিযোগিতার শুরু থেকেই আলোচনায় উঠে আসেন বাংলাদেশের ছেলে নোবেল। তাঁর কণ্ঠে জেমসের ‘মা’ কিংবা আইয়ুব বাচ্চুর ‘হাসতে দেখো’ গানগুলো রীতিমতো ঝড় তোলে। ঢাকার ছোট একটি এলাকা থেকে উঠে আসা এই তরুণ রাতারাতি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তারকা হয়ে ওঠেন। যোগ দেন গান দিয়ে দুই বাংলার তরুণ শিল্পীদের মধ্যে সেরা হওয়ার চূড়ান্ত লড়াইয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৃতীয় অবস্থান নিয়েই যাত্রা শেষ হয় নোবেলের। দেশের ছেলে ফিরে আসেন দেশে। বিজয়ীর মুকুট পাননি তো কী হয়েছে, বাংলাদেশে ফিরতেই নোবেলের ব্যস্ততা যে হারে বেড়েছে, তাতেই বোঝা যায় এ শিল্পী শ্রোতাদের বিচারে জয় পেয়ে গেছেন। একের পর এক অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন নোবেল। নিজের দল নোবেলম্যানকে নিয়ে ছুটে চলছেন দেশের নানা প্রান্তে। ব্যস্ততার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে নোবেল বললেন, ‘এই অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা–চট্টগ্রাম মিলে চারটি শো করলাম। প্রায় দিনই কোথাও না কোথাও শো হচ্ছে।’

শুধু দেশেই নয়, নোবেলের গান ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরের প্রবাসী বাঙালি শ্রোতাদের মধ্যেও। এটা বোঝা গেল আগামী এক মাসে নোবেলের সফরসূচি জে। নোবেল জানালেন, সারেগামাপা শেষ হতে না হতেই তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দুবাই, মালয়েশিয়াতে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে গান করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এ মাসের শেষের দিক থেকে শুরু করে টানা ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরে চলবে তাঁর এই সংগীতসফর।

নোবেল ছবি: আনন্দ
নোবেল ছবি: আনন্দ

বদলে যাওয়া জীবন

প্রথমেই জানতে জানতে চাইলাম, সারেগামাপার পর তাঁর জীবনে আসা পরিবর্তনগুলো কী?—এমন প্রশ্ন শুনে নোবেল কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন। এরপর বললেন, ‘আগে কেউ আমাকে চিনতেন না, এখন অনেকেই চেনেন। আগে যতটা পরিশ্রম করতাম, ততটা মূল্য পেতাম না। এখন পাচ্ছি। আগে রাস্তাঘাটে আড্ডা দিতে পারতাম, এখন একটু সময়ের জন্য দাঁড়ালেই সবাই ভিড় করেন, সেলফি তুলতে আসেন। সারেগামাপাতে যাওয়ার আগে নিজের টাকায় কোরবানি দিতে পারিনি, এবারের ঈদে নিজের আয়ের টাকা দিয়ে কোরবানি দিচ্ছি।’

নোবেলের প্রেমের গল্প

শিল্পীদের প্রশ্ন করলেই বলেন, শিল্পের সঙ্গে তাঁর প্রথম প্রেম। তাই নোবেলকে প্রশ্নটা করা হয় এভাবে—‘গান বাদে নোবেল জীবনে প্রথম প্রেমে পড়েছেন কবে?’ প্রশ্ন শুনে মনে হলো কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন নোবেল। একটু দম নিয়ে বলেন, ‘ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে প্রেমে পড়েছিলাম। এতটুকুই।’ এর বাইরে নোবেল আর কিছু বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, ‘২০০৮ সালে প্রেমটা হয়েছিল। মাফ করবেন, এর বেশি আর কিছুই বলতে চাই না। আমার ব্যক্তিজীবনের গল্প সবাইকে জানিয়ে কীই–বা হবে?’ বলেই আলাপ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য তাগিদ দিলেন রাতারাতি তারকা হয়ে যাওয়া এই শিল্পী।

নোবেলের জীবন নিয়ে সিনেমা

ছোটবেলা থেকে অনেক চড়াই–উতরাই দেখেছেন এই শিল্পী। পড়াশোনা নিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। গানই তাঁর জীবন—এটা পরিবারকে বোঝানোর জন্য করতে হয়েছে সংগ্রাম, ছাড়তে হয়েছে বাড়ি। সেই গল্প সিনেমাকেও হার মানায়। তাই নোবেলের জীবন নিয়ে সিনেমা তৈরি হলে নায়ক হিসেবে সেখানে কাকে দেখতে চান তিনি? হেসে জবাব দেন নোবেল, ‘আমার জীবন নিয়ে সিনেমা হবে, সেই যোগ্যতাই তো হয়নি আমার। আর যদি বানাতেই হয়, সেটা পরিচালক বুঝবেন। আমার চাইতে আরও অনেক ভালো ও গুণী মানুষ আছেন, আগে তাঁদের নিয়ে কাজ হোক। কখনো গান দিয়ে আমি যদি হলিউড–বলিউডে যেতে পারি, তখন হতে পারে’, বলেই হাসেন তিনি।

অভিনয়ের ইচ্ছা

নোবেলের বায়োপিক নিয়ে আগ্রহ না থাকলেও সিনেমাতে তাঁর অভিনয়ের আগ্রহ আছে। তাঁর কথায় জানা যায়, ছোটবেলায় থিয়েটার করতেন। বাবার সঙ্গে মঞ্চনাটকে অভিনয়ও করেছেন তিনি। নোবেল বলেন, ‘আগে যেহেতু অভিনয় করেছি, তাই অভিনয়ের আগ্রহ কিছুটা তো আছেই। তবে যত দিন গান নিয়ে তৃপ্ত না হচ্ছি, তত দিন অভিনয় করব না।’

নোবেল ছবি: আনন্দ
নোবেল ছবি: আনন্দ

তবে সময় পেলেই নোবেল নিয়মিত সিনেমা–নাটক দেখেন। তাঁর প্রিয় নায়ক–নায়িকার তালিকায় আছেন মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান; বলিউডে সালমান খান, নানা পাটেকর, বিদ্যা বালানরা।

সমালোচনার মুখোমুখি

খ্যাতির পথে যেমন প্রশংসা আছে, আছে সমালোচনাও। সমালোচনা শুনলে বা পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব পড়লে কেমন লাগে? এর উত্তর নোবেল দেন এভাবে—‘সমালোচনা করার ধরনের ওপর নির্ভর করে সব। মানুষ কি শুধু ঠাট্টা করার জন্য সমালোচনা করছে, নাকি আমার ভালো চায়, বিষয়টি বুঝে আমি সেই সমালোচনার মূল্যায়ন করি। কারণ, আমাকে নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা হলে সেটা আমার ভালো হবে বলে আমি মনে করি। জীবনে চলার পথে ভুল তো হতেই পারে। অনেক সমালোচনা থেকে নিজের সেই ভুল শুধরে নেওয়া যায়।’

জীবনের কঠিন সময়

২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের সারেগামাপাতে যোগ দেওয়ার আগপর্যন্ত সময়টা খুব কঠিন ছিল নোবেলের। ২০১৪ সালে এ লেভেল দেওয়ার পর পড়ালেখা ছেড়ে দেন। তখন পরিবার, আত্মীয় ও সমাজের কাছে ‘বখাটে ছেলে’ হিসেবে অ্যাখ্যা পান তিনি। নোবেল বলেন, ‘গানই ছিল আমার নেশা। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমাকে দিয়ে পড়াশোনা আর গান একসঙ্গে হবে না। তাই পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার কারণে মা ও বাবাকে অনেকের কাছে কথা শুনতে হয়েছে, সামাজিকভাবে ছোট হতে হয়েছে। সত্যি কথা, এই চার বছর আমার খুবই কঠিন সময় গেছে।’

হতাশার দিনগুলোতে নোবেলের প্রায় প্রতিদিনই মনে হতো, নাহ আর হবে না, থেমে যাবেন। মনে হতো, গায়ক হওয়ার স্বপ্ন বুঝি আর পূরণ হবে না। নোবেল বলেন, ‘তখনই আবার মনে হতো, না আমার দ্বারাই হবে। হেরে যাওয়া যাবে না। হতাশা তো আসবেই। সেটাকে উতরে যেতে হবে। আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য ও সহ্যকে নিজের মধ্যে পুষে রাখতে হবে।’

সারেগামাপার গ্র্যান্ড ফিনালেতে গাইছেন নোবেল
সারেগামাপার গ্র্যান্ড ফিনালেতে গাইছেন নোবেল

এই যে রাতারাতি তারকা হয়ে গেলেন নোবেল, এই খ্যাতি নোবেলের মনে ভয়েরও জন্ম দেয়। তিনি বলেন, ‘স্বল্প সময়ে আমার অর্জনটা বেশি। তাই ভয়ও বেশি। অনেক সময় অর্জন কমে যেতে পারে, আমি হারিয়ে যেতে পারি। তাই একটা ভয় তো থাকেই।’ যদি একদিন ঘুম ভেঙে দেখেন গায়ক নোবেলকে কেউ চিনছেন না, তখন কী করবেন? চটজলদি তিনি বলেন, ‘আরও ভালোভাবে আবার নতুন করে কাজ শুরু করব। এরপর ইন্ডিয়ান আইডলে যাব। কাঁপিয়ে দিয়ে আসব। হা হা হা...চেষ্টা থাকলে সবই সম্ভব।’ এরপর বলি, গান গাইতে না পারলে নোবেল কী করবেন? এবারও সময় নিলেন না। বলেন, ‘নিজে গান লিখব, সুর করব। আমার চিন্তার সঙ্গে মিলবে এমন কাউকে খুঁজে বের করে তাঁকে দিয়ে গাওয়াব। গানের সঙ্গেই থাকতে হবে। ব্যবসা, চাকরি আমার দ্বারা হবে না।’

এক বছরে সবচেয়ে প্রাপ্তি, ব্যর্থতা

বিগত এক বছরে নোবেলের ঝুলিতে কোনো ব্যর্থতা নেই। শুধুই প্রাপ্তিতে ভরে আছে তাঁর অর্জনের খাতা। নোবেল বলেন, ‘দেশজুড়ে মানুষের যে পরিমাণ ভালোবাসা পেয়েছি, বলে বোঝাতে পারব না। সারেগামাপা অনুষ্ঠান তো আগেও হয়েছে। কিন্তু এবার আমি অংশ নিয়ে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছি, আমার মনে হয় আগে কখনোই হয়নি এমন।’

মৌলিক গান ও নোবেলম্যান

নোবেলের ব্যান্ড নোবেলম্যান থেকে শিগগিরই মৌলিক গান আসছে, সুখবরটা আমাদের দিলেন নোবেল। এরই মধ্যে চারটির মতো গান করা হয়েও গেছে। তিনি বলেন, ‘একটু সময় নিয়ে গানগুলো ছাড়তে চাই। চারটি গান হয়ে গেছে। এখন গানগুলোর ভিডিও করব। আমরা চাইছি দু-তিন মাস পরপর একটি করে গান বাজারে আনতে।’

সারেগামাপার প্রত্যাশা-প্রাপ্তি

যেকোনো প্রতিযোগিতায় সবারই চূড়ান্ত শিরোপা অর্জন লক্ষ্য হতে হবে, এমনটা মনে করেন না নোবেল। সারেগামাপার প্রথম পর্ব প্রচারের পরই যে সাড়া তিনি পেয়েছেন, তা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ছিল বলে মনে করেন নোবেল। তিনি বলেন, ‘টিভিতে যেদিন প্রথম পর্ব দেখাল, ওই দিনই আমি আমার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পেয়ে গেছি। এরপর একের পর এক সাফল্য এসেছে, এটি আমার বাড়তি পাওয়া।’