পর্দায় গল্প-সংকট, গল্পহীনতার দায় বর্তায় সবার ঘাড়ে

কোথাও কেউ নেই নাটকে লুৎফর রহমান জর্জ, আসাদুজ্জামান নূর ও সুবর্ণা মুস্তাফা
কোথাও কেউ নেই নাটকে লুৎফর রহমান জর্জ, আসাদুজ্জামান নূর ও সুবর্ণা মুস্তাফা

দক্ষ রাঁধুনি যেভাবে রেঁধে ফেলতে পারেন মজার সব খাবার, পরিচালক অনেকটাই সে রকম। খুঁজে খুঁজে তাঁকে বের করতে হয় ভালো গল্প, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক। অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের দিয়ে করিয়ে নিতে হয় কাজ। এভাবেই নির্মিত হয় মন রাঙানো নাটক বা সিনেমা। ভালো খাবারের স্বাদ যেভাবে মুখে লেগে থাকে, পরিচালকের শিল্পরন্ধন সেভাবে লেপ্টে থাকে দর্শকের মনে ও মননে। রোমাঞ্চিত দর্শক প্রিয়জনদের সঙ্গেও সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেন।

এখন কি সেসব দেখা যায়? নাটক-সিনেমা দেখে ভুলে যাচ্ছেন দর্শকেরা। ঢাকাই বিনোদনের পেছনে সময় আর অর্থ ব্যয় করে তবে কী পাচ্ছেন তাঁরা? বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাটকের সুবর্ণ সময় যেন গত শতকের নব্বইয়ের দশক। টেলিভিশনে তখন দেখা একজন আয়নাল লস্কর, নাল পিরান, রূপনগর, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, অয়োময় নাটকগুলো মানুষের মন থেকে মোছেনি। কিংবা বেদের মেয়ে জোসনা, সত্যের মৃত্যু নাই, আম্মাজান সিনেমাগুলোও। এখনকার নাটক-সিনেমায় গল্প থাকে না, এ আক্ষেপ স্বয়ং পরিচালকদেরও। তরুণ পরিচালকদের অনেকে জাদুকরের মতো, অদৃশ্য চিত্রনাট্যে নির্মাণ করেন নাটক। সেখানে সংলাপ যেন চিত্রনাট্যকারের চেয়ে ভালো জানেন অভিনয়শিল্পীরা। অথচ নব্বইয়ের নির্মাতাদের অনেকে জানালেন, ওই সময়ে পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করে চিত্রনাট্য লিখতেন চিত্রনাট্যকারেরা। পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে দৃশ্যের সংযোজন-বিয়োজন-পরিমার্জন হতো। শোনা যায়, এখন নাকি মুখে মুখেই চিত্রনাট্য হয়ে যায়।

চিত্রনাট্যের দুর্বলতা বা গল্পহীনতার পেছনে কারণ অনেক। প্রথম কারণ, ভালো গল্পের মানসম্মত চিত্রনাট্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। এর পেছনে অর্থ ব্যয় করা বা সময় দেওয়ার মানসিকতা নেই বেশির ভাগ প্রযোজকের। ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘অনেককেই দেখি শুধু একটি আইডিয়ার ওপর মুখে মুখেই নাটকের গল্প বানিয়ে ফেলে। এসব কাজে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় নেই কারও। এ জন্যই বাংলাদেশের নাটকের ওপর থেকে মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা উঠে গেছে।’

জ্যেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক ছটকু আহমেদের মতে, সৃষ্টির বদলে এখন গল্পকে মেরে ফেলা হচ্ছে। লেখকেরা দর্শকের জন্য নয়, নায়ক-নায়িকা বা প্রযোজকের জন্য গল্প লেখেন। তিনি বলেন, ‘প্রযোজক একটা মেয়ে বা ছেলে এনে বলেন, “একে নায়িকা-নায়ক বানাব। দেখবেন মাহি-শাকিব ইন্ডাস্ট্রি থেকে ফিনিশ। এদের ওপর একটা গল্প লিখে দেন।”’ দর্শকের জন্য গল্প না লিখে ওই মেয়ে বা ছেলের জন্য গল্প লিখতে হয়। কী করে সেই গল্প চলবে? ইউটিউবে ভালো ভালো ছবি বিনে পয়সায় দেখা যায়। ফলে শাকিব-মাহিকে ফিনিশ করতে গিয়ে সেসব প্রযোজক আর নায়ক-নায়িকা ফিনিশ হয়ে যান। কার জন্য ছবি বানাচ্ছি, সেখানে কী বলতে চাইছি, দর্শক ছবিটা কেন দেখবে—এসব এখন আর কেউ মাথায় রাখে না। তাই হল থেকে বেরিয়ে দর্শক এখন গল্পটা বলতে পারে না।’

নাট্যকার সংঘের সাধারণ সম্পাদক এজাজ মুন্না মনে করেন, নাটক থেকে গল্প উধাও হয়ে যাওয়ার দায় এককভাবে কাউকে দেওয়া যাবে না। এটি সমন্বিত শিল্প। নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, চ্যানেল, এজেন্সি—সবাইকে যৌথভাবে এ দায় নিতে হবে। বাজেট বাড়াতে হবে, পরিচালককে গল্প ও শিল্পী বাছাইয়ের স্বাধীনতা দিতে হবে।

নতুন নাট্যকার তৈরি ও ভালো গল্প বাছাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে নাট্যকার সংঘ। এ জন্য তারা চালু করেছে চিত্রনাট্য ব্যাংক। এই ব্যাংকে জমা হওয়া নাটক থেকে বেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ গল্পের নাটক পাঠানো হবে নির্মাণের জন্য। এজাজ মুন্না বলেন, ‘ভালো গল্পের সংকট এক দিনে দূর হবে না। আমরা প্রতিবছর চিত্রনাট্যের কর্মশালা করাচ্ছি। সেখানে যোগ দেওয়া নতুন নাট্যকারদের অনুপ্রাণিত করতে তাঁদের চিত্রনাট্যে নাটক নির্মিত হয়েছে। ইতিমধ্যে চ্যানেল আই একটি প্রচার করেছে, শিগগির আরটিভি করবে।’

সালাহউদ্দিন লাভলু মনে করেন, নাটকের বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং এজেন্সি, চ্যানেল বা প্রযোজকের অভিনয়শিল্পী বেঁধে দেওয়া বন্ধ করা দরকার। তিনি বলেন, ‘ঈদের পরে আমরা শুটিংয়ের নিয়মানুবর্তিতা ঠিক করে ফেলব। সময়মতো চিত্রনাট্য তৈরি ও শিল্পীদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।