গফুর হালীকে মনে রাখেনি কেউ!

আবদুল গফুর হালী (৬ আগস্ট ১৯২৮—২১ ডিসেম্বর ২০১৬)
আবদুল গফুর হালী (৬ আগস্ট ১৯২৮—২১ ডিসেম্বর ২০১৬)

আবদুল গফুর হালী নামের সঙ্গে অনেকের কৈশোর, তারুণ্যের স্মৃতি জড়িত। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনি স্মৃতিজাগানিয়া। চট্টগ্রামে তো বটেই, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অনেক এলাকায় হাটে-ঘাটে-মাঠে-ময়দানে তাঁর গান বাজতে শোনা যেত। ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা’, ‘পাঞ্জাবিঅলা মনে বড় জ্বালারে’, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুল গো’, ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবার লাই’, ‘অ শ্যাম রেঙ্গুম ন যাইও, বানুরে অ বানু’, ‘বইনদ্দি নওশিরো, নিশিরও কালে’ কিংবা মাইজভান্ডারি গান ‘দেখে যারে মাইজভান্ডারি হইতাছে নূরের খেলা’, ‘কত খেলা জানোরে মাওলা’, ‘মাইজভান্ডারে কী ধন আছে’ এবং মোহছেন আউলিয়ার গান ‘চল যাই জিয়ারতে মোহছেন আউলিয়ার দরবারে’, ‘আল্লাহর ফকির মরে যদি’—এমন অনেক গানের স্রষ্টা আবদুল গফুর হালী। আবদুল গফুর হালী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক, মাইজভান্ডারি, মুর্শিদি, মারফতি ধারায় দুই হাজারের অধিক গান লিখেছেন।

আবদুল গফুর হালীকে নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি ‘মেঠো পথের গান’ অনুষ্ঠানে
আবদুল গফুর হালীকে নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি ‘মেঠো পথের গান’ অনুষ্ঠানে

৬ আগস্ট ছিল আবদুল গফুর হালীর ৯১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৮ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার রশিদাবাদে তাঁর জন্ম। বাবা আবদুস সোবহান, মা গুলতাজ খাতুন। রশিদাবাদ আরেক সাধকশিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিতের গ্রাম। ৮০ বছরের বেশি সময় সুর-সংগীতে এক আড়ম্বরপূর্ণ কিন্তু ব্যক্তি জীবনে সাদাসিধে জীবন কাটিয়ে তিনি চলে যান চির অন্ধকারের দেশে, ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত লিখেছেন, সুর তুলেছেন এবং গেয়েছেন।

৬ আগস্ট ৯১তম জন্মবার্ষিকীর পর কেটে গেল তিনটি দিন। মানুষটিকে মনে রাখেনি কেউ। চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন স্মরণ করেনি আবদুল গফুর হালীকে। তাঁর গান গেয়েছেন বা নতুন করে সংগীত পরিচালনা (রিমিক্স) করে আলোচনায় এসেছেন, বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছেন, এমন কোনো তারকা শিল্পীকেও স্মরণ করতে দেখা যায়নি তাঁকে। যা হয়েছে ফেসবুকে, কয়েকজন ভক্ত পুরোনো ছবি দিয়ে স্মরণ করেছেন।

আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর বেঞ্জামিন ক্রাকাউর ও লোকগবেষক নাসির উদ্দিন হায়দার
আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর বেঞ্জামিন ক্রাকাউর ও লোকগবেষক নাসির উদ্দিন হায়দার

যে বছর চলে গেলেন চিরতরে অর্থাৎ ২০১৬ সালে সর্বশেষ কথা হয় তাঁর সঙ্গে, হাতিরপুলে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশনের অফিসে। অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন। গানের দুনিয়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা, পাওয়া না-পাওয়া; নানা বিষয়ে। সেদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, স্থানীয় রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিনি লেখাপড়া করেছিলেন। তবে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পর ইস্তফা দেন। কোনো বিদ্যায়তনে লেখাপড়া আর সংগীতের হাতেখড়ি নেই তাঁর। তাঁর নাম আবদুল গফুর, ‘হালী’ তাঁর মুর্শিদের দেওয়া উপাধি। তিনি বলতেন, ‘যাঁরা গান লেখেন, যাঁরা কবিতা লেখেন, তাঁদের কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এটা ভাবের জিনিস।’

তাঁর মতে, ভাব আসে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতিই তাঁর গুরু। এক স্মৃতিচারণায় তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কারণে লেখাপড়া করা হয়নি তাঁর। চোখের সামনে মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। সে সময় জাপান-জার্মানির যুদ্ধ চলছে। এসব কিছু তাঁর ভাবনার জগৎকে বদলে দিয়েছিল।

৬ আগস্ট ছিল আবদুল গফুর হালীর ৯১তম জন্মবার্ষিকী
৬ আগস্ট ছিল আবদুল গফুর হালীর ৯১তম জন্মবার্ষিকী

আবদুল গফুর হালীর ভাবসংগীতে আসা পরিকল্পনা করে বা পারিবারিক সূত্রে নয়। ভাবের সুর তাঁকে এ পথে এনেছে তরুণ বয়সে, তাঁর বিয়ের পর। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। সংসার গোছাতে বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দেন। ওই সময় লাল পোশাক পরা মাইজভান্ডারি লোকেরা তাঁর মনে জায়গা করে নেন। এমনিতে ছোটবেলা থেকে সুফি সাধক আসকর আলী পণ্ডিতের গান শুনে বড় হয়েছেন তিনি। একই এলাকার মানুষ। আলোড়িত হয়েছিলেন রমেশ শীল, বজলুল করিম মন্দকিনি আর মৌলভি হাদীর ভাবসংগীতে। সে সময় একবার তিনি হাজির হন মাইজভান্ডার শরিফে। মাইজভান্ডারের ঢোলের বাদ্য আর গান তাঁকে অস্থির করে তোলে। মন কাড়ে ভক্তদের ‘বিনয় ভাব’। ‘বিনয় ভাব’ মানে ‘ভক্তির আনত ভাব’, ভক্তির প্রেমে হারিয়ে যাওয়া। সঙ্গীরা তাঁকে বললেন গান গাইতে। গাওয়ার পর যখন চোখ খুললেন, দেখেন হারমোনিয়ামের ওপরের অংশ টাকায় ঢেকে গেছে। তারপর বাড়ি ফিরে আবদুল গফুর হালী অনুভব করলেন, ‘কে যেন বলছে, লেখ, লেখ!’ মুখে মুখেই লেখা হয়ে গেল আরেকটি গান, ‘আর কতকাল খেলবি খেলা, মরণ কি তোর হবে না, আইল কত গেল কত, কোথায় তাদের ঠিকানা’।

সেই সময়ে গানটা মনে গেঁথে গেল। শিল্পী নিজেই বলেছিলেন ‘গাইতে গাইতে আমি পুরোপুরি শিল্পী।’ তাঁর স্মৃতিচারণাটা ছিল এমন, ‘উঠানে বসে গান হতো। আমাদের দেশে (চট্টগ্রামে) এটাকে নাট্যপুয়ার গান বলে। মানে এ রকম আসর প্রায়ই হইতো। আমি গানের পোকা ছিলাম। আর বিশেষ করে, সিনেমার পোকা বেশি ছিলাম। তখন সিনেমা খুব মিষ্টি একটা জিনিস ছিল। তখন আমি এই সিনেমার গান শুনে শুনে হুবহু করে করে গাইতাম। গাইতে গাইতে আমি শিল্পী হয়ে গেলাম।’


জীবনকালে যোগ্য সম্মান পাননি। পাননি জনপ্রিয় গানগুলোর প্রকৃত রয়্যালটি। তাঁর গান গেয়ে কত শিল্পী তারকা হয়েছেন, দেশ-বিদেশে নাম করেছেন, উপার্জন করেছেন—অথচ সারাটা জীবন দারিদ্র্যের ছায়ায় ছিল তাঁর বসবাস। শেষ দিনগুলোতে চিকিৎসার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছিল। চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন নিজ উদ্যোগে।

যৌবনে আবদুল গফুর হালী
যৌবনে আবদুল গফুর হালী

অবশ্য বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান তাঁকে ও তাঁর কাজকে পাত্তা না দিলেও দেশের বাইরে প্রচুর কাজ হয়েছে আবদুল গফুর হালীকে নিয়ে। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গান নিয়ে গবেষণা করছেন একদল লোকগবেষক। জার্মান ভাষায় তাঁকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র। জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবর্ষ-বিষয়ক দর্শন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক হানস হার্ডার ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। পরে শিল্পী কল্যাণী ঘোষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে। ২০০৪ সালে হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হান্স হার্ডার আবদুল গফুর হালীর ৭৬টি গান জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ‘ডর ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’ বা ‘পাগলা গফুর বলে’ শিরোনামে গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সে বইতে হান্স হার্ডার লিখেছেন, ‘বাংলার লোকসংগীতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে বিশেষভাবে অধিষ্ঠিত করেছেন আবদুল গফুর হালী। এসব গান কালের সীমা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এবং বেশ আদৃত হচ্ছে। আবদুল গফুর হালী প্রথম মোহছেন আউলিয়াকে নিয়ে গান রচনা করেন। চট্টগ্রামের ভাষায় প্রথম লোকনাটকের রচয়িতাও গফুর হালী।’ হার্ডার আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে লেখেন, ‘আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজেকে শুধু বাংলা সাহিত্যের দিকে সরাসরি ধাবিত করেননি, সুর ও আধ্যাত্মবাদে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।’

২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার বছরে সময়ে সুফি মিজান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আবদুল গফুর হালীর ৩০০ গানের স্বরলিপিসহ তিনটি গীতিকাব্য ‘সুরের বন্ধন, শিকড়, দিওয়ানে মাইজভান্ডারি’ ও ‘আবদুল গফুর হালীর চাটগাঁইয়া নাটক সমগ্র’ প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের গানের ইতিহাসে কেবল গফুর হালীর গানেরই স্বরলিপিসহ গীতিকাব্য প্রকাশিত হয়েছে। আবদুল গফুর হালীর গানের সংরক্ষণ ও প্রচারে ইতিমধ্যে আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

শেষবার রাতের বাসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফেরার সময়টা খুব মনে পড়ে। যাওয়ার আগে বিদায়বেলায় হাত মেলাতে মেলাতে বলছিলেন, ‘এবারই শেষ। আর ঢাকায় আসা হবে না। ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েন।’ এভাবে বলছেন কেন? ঠিক এ প্রশ্নটাই করেছিলাম। প্রশ্নটা শেষ হওয়া মাত্রই দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘এটাই তো নিয়ম। চলে যেতে হবে।’ সত্যি সত্যি তিনি কথা রেখেছিলেন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধের গান করেছিলেন ঢাকায় এসে। কলমটাকে অস্ত্র বানিয়েই যুদ্ধ করেছিলেন। ওই সময় তিনি লিখেছিলেন, ‘তোর লয় আঁর লয় ন অইব অভাই আঁই বাঙালি/ তুই পাঠান/ তোর দেশে আর আঁর দেশে/ দুই হাজার মাইল ব্যবধান’। গানটি গাইতেন ঘুরে ঘুরে। বঙ্গবন্ধুর সামনেও গান করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।

সপরিবারে আবদুল গফুর হালী
সপরিবারে আবদুল গফুর হালী

আবদুল গফুর হালীকে যথাযথ মনে রাখেনি কেউ। তিনি পাননি রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি। ৯১তম জন্মবার্ষিকীতে যে অল্প কয়েকজন অনুরাগী তাঁকে স্মরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সাংবাদিক ও চট্টগ্রামের লোকসংগীত গবেষক নাসির উদ্দিন হায়দার। তিনি বলেন, ‘কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সংগীত সাধনার মাধ্যমে তিনি অসামান্য জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন। বর্তমানে জনপ্রিয় সংগীত-ধারা মোহছেন আউলিয়ার গান তাঁর হাতের সৃষ্টি। গফুর হালী হলেন প্রকৃতির সন্তান। তার প্রতিটি গান যেন ভালোবাসার অলৌকিক শিল্প। রাষ্ট্রীয়ভাবে গফুর হালীর মূল্যায়ন অনেক আগেই হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তা হয়ে ওঠেনি।’