রাজ্জাক নেই, সুনসান লক্ষ্মীকুঞ্জ

রাজ্জাকের সঙ্গে দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট।  ফাইল ছবি
রাজ্জাকের সঙ্গে দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট। ফাইল ছবি

গুলশান–২ এর লক্ষ্মীকুঞ্জে এখনো সুনসান নীরবতা। দুই বছর আগে আজকের সন্ধ্যায় নায়ক রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো দেশ। সেই স্তব্ধতা আজও ঝুলে আছে লক্ষ্মীকুঞ্জের ব্যালকনিতে। যেখানে একটা চেয়ার পেতে বসতেন নায়ক রাজ্জাক। নাতি ও তাঁদের প্রিয় কুকুরটিকে নিয়ে খেলতেন। সেই ব্যালকনি এখন শূন্য। শূন্যতার দুই বছর পূর্তি আজ।

লক্ষ্মীকুঞ্জ ঘুরে ফেরার পথে দেখা হয় অভিনেতা সম্রাটের সঙ্গে। ব্যবসায়িক কাজে বড় ভাই বাপ্পারাজের সঙ্গে উত্তরা থেকে ফিরেছেন তখন। বাবাকে ছাড়া ৭৩০ দিন কীভাবে পার হয়ে গেল, ভাবতেই আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন সম্রাট। ‘মনে হয়, আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যাননি। তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। সব সময় আমরা এটাই অনুভব করি’, বলেন সম্রাট।

বাস্তবতা বলে অন্য কথা। সেটা মেনে নিতে মন খারাপ হয়ে যায় ছোট-বড় সবার। বাসা থেকে বের হওয়া বা ঢোকার সময় বাবার সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার অভ্যাস ছিল দুই ভাইয়ের। গত দুই বছর সেটা ভীষণভাবে মিস করছেন।

লক্ষ্মীকুঞ্জের রেওয়াজ ছিল একসঙ্গে সকালের নাশতা ও রাতের খাবার খাওয়ার। বাবার চেয়ারটা এখন খালি থাকে। শূন্য শূন্য লাগে সম্রাটদের। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই একসঙ্গে খাচ্ছি, গল্প করছি, আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ আব্বার চেয়ারটায় চোখ পড়লে খুব কষ্ট হয়।’

বেলা দুইটা বাজলে সন্তানকে ফোন করে খবর নিতেন রাজ্জাক। সম্রাট বলেন, ‘বাবা বলতেন, এই তুই কই? অফিসে? আসবি কখন? আমি বসে আছি, একসঙ্গে খাব।’ রাত ১০টা বাজলে শুটিংয়ে থাকলে ফোন করতেন, ‘কী রে, রাত ১০টা বাজে, শুটিং এখনো প্যাকআপ হয়নি। খাবি না? আমি কি খেয়ে নেব? ১১টা বাজবে? আমি ওয়েট করছি, আয় একসঙ্গে খাব।’ আমি বলতাম, ‘আপনার ওষুধ আছে, আপনি খেয়ে নেন।’ ছোট ছোট স্মৃতিগুলো মনে করতেই দুর্বল হয়ে যায় সম্রাটের কণ্ঠ। বলেন, ‘বাবার টাইম টু টাইম ফোন করে খবর নেওয়া, বিভিন্ন কাজে পরামর্শ দেওয়াটা খুব মিস করি। তিনি ছাড়া একেবারে শূন্য মনে হয়।’

রাজ্জাকের স্ত্রী খায়রুন্নেসা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও সন্তান ও নাতি-নাতনিরা মিলে চেষ্টা করেছেন তাঁকে প্রফুল্ল রাখতে। মায়ের একাকিত্ব ঘোচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছেন ছেলেরা। বাপ্পারাজের সন্তানদের জন্মের সময় রাজ্জাক অনেক ব্যস্ত অভিনেতা। সম্রাটের বড় সন্তান আরিশা যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন রাজ্জাক অভিনয় থেকে অনেকটাই দূরে। তখন অভিনয় কমিয়ে দেওয়ায় নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতেন। আরিশার ছোট বোন আরিবাও দাদার সঙ্গে খেলাধুলা করতেন। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতেন। এখন দাদা ছাড়া তাঁরাও বন্ধুহীন হয়ে পড়েছেন। হই–হুল্লোড়ে মেতে থাকা বাড়িটি হয়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ।

রাজ্জাকের শোবার ঘরের সবকিছু সাজানো আছে আগের মতোই, যেমনটা তিনি পছন্দ করতেন। তাঁর কাপড়চোপড়, পারফিউমের বোতলগুলো, এমনকি গোসলের সাবানও এখনো বাথরুমে রয়ে গেছে, যেভাবে তিনি রেখে গিয়েছিলেন হাসপাতালের পথে।

অভিনয়ের নেশায় স্ত্রী খায়রুন্নেসা ও বড় ছেলে বাপ্পারাজকে নিয়ে কলকাতা থেকে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় এসেছিলেন রাজ্জাক। উঠেছিলেন ঢাকার কমলাপুরে। তারপর দিলু রোড, ফার্মগেটের পর থিতু হন গুলশান–২ নম্বর রোডের লক্ষ্মীকুঞ্জে। স্ত্রী খায়রুন্নেসাকে লক্ষ্মী নামেই ডাকতেন রাজ্জাক। দুই বছর হলো ঠিকানা বদল হয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিতুল্য এই অভিনেতার। বনানীর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ৩৬৬৯/১–এই ঠিকানায় তিনি চিরঘুমে। আর কখনো নীল আকাশের নিচে হাঁটবেন না তিনি, গাইতে দেখা যাবে না কোনো অভিমানী গান। তাঁর এই চলে যাওয়াতে হই–হুল্লোড়ে মেতে থাকা লক্ষ্মীকুঞ্জও যেন সুনসান নীরব। মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বাড়ির পরিবেশ তেমনটাই বলছিল।

রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার টালীগঞ্জে, বেড়ে ওঠাও সেখানে। ইচ্ছে ছিল খেলোয়াড় হওয়ার। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মঞ্চনাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য স্পোর্টস শিক্ষক তাঁকে বেছে নেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজ্জাক ছিলেন সবার ছোট। মেজ ভাইয়ের সাহায্যে অভিনয়জগতে আসার সব সহযোগিতা পান রাজ্জাক। এসএসসি পাস করার পর অভিনয় শুরু করেন। ধীরে ধীরে টিভি নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যান, জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯৬২ সালে বিয়ে করেন তিনি। কলকাতায় অভিনয় করতে গিয়ে উত্তম কুমারের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্জাক। সংস্পর্শে আসেন তপন সিনহা এবং পরিচালক পীযূষ বোসের। পীযূষ বোসের পরামর্শেই ঢাকায় আসেন তিনি।