হ্যামলেটের 'লাকি থার্টিন'

জাতীয় নাট্যশালায় শুক্রবার রাতে মঞ্চস্থ হ্যামলেট নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় নাট্যশালায় শুক্রবার রাতে মঞ্চস্থ হ্যামলেট নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো

জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনের সামনে দর্শকের দীর্ঘ সারি। দুটি প্রবেশপথে ঢোকার অপেক্ষায় দর্শকের সারি সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে বেশ খানিকটা দূরে। নাটক শুরুর পর সুবিশাল মিলনায়তনের বেশির ভাগ আসন পূর্ণ। 

এমন দৃশ্য বহুদিন পর দেখা গেল ঢাকার নাট্যাঙ্গনে, গতকাল শুক্রবারে। জাতীয় নাট্যশালায় এদিন মঞ্চায়িত হয় শিল্পকলা একাডেমি প্রযোজিত নাটক ‘হ্যামলেট’। আর নাটকটি দেখার জন্য দর্শকের এমন ভিড়।

এদিন ছিল হ্যামলেটের ১৩তম প্রদর্শনী। বলা হয়ে থাকে ১৩ সংখ্যাটা অপয়া। কিন্তু দর্শক উপস্থিতির বিচারে বিষয়টা উল্টো হয়েছে। বরং ‘লাকি থার্টিন’ লিখলে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। ৯০ হাজার ৫০০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে। বিভিন্ন শ্রেণির মোট ৬২৩টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। কিছু আমন্ত্রিত অতিথিও দেখেন নাটকটি। নাটক শুরুর আগে করিডরে দাঁড়িয়ে একাডেমির সহকারী পরিচালক (নাটক) আলী আহমেদ মুকুল প্রথম আলোকে জানান, শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব প্রযোজনা হলেও নাটকটি এখন মূলত প্রদর্শনীর আয়েই চলছে। অর্থাৎ নাটক প্রদর্শন করে যে অর্থ আয় হয়, তাই ব্যয় করা হয় মহড়া, শিল্পী সম্মানী এবং অন্যান্য খাতে। ইতিমধ্যে এক লাখ টাকার তহবিলও হয়ে গেছে।

নাটক শুরু হয় নির্ধারিত সময়েই। পুরোনো গল্প। পিতৃহত্যার প্রতিশোধের নেশায় মত্ত ডেনিশ যুবরাজ হ্যামলেট। অভিযুক্ত চাচাকে হত্যার সুযোগ পেয়েও সে হত্যা করে না। কেন? ক্লডিয়াস ওই সময়টায় প্রার্থনারত ছিল বলে? এ রকম অনেক প্রশ্নেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভিড় করে হ্যামলেটের মনে। সৈয়দ শামসুল হক অনূদিত শেক্‌সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকটির অন্য রকম উপস্থাপনা ছিল।

নাটকে হ্যামলেট চরিত্রে মাস্উদ সুমন, গারট্রুড চরিত্রে সংগীতা চৌধুরী অভিনয় করেছেন। ছবি: সংগৃহীত
নাটকে হ্যামলেট চরিত্রে মাস্উদ সুমন, গারট্রুড চরিত্রে সংগীতা চৌধুরী অভিনয় করেছেন। ছবি: সংগৃহীত

উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার রচিত হ্যামলেট বিশ্ববাসীর অতিপরিচিত এবং অতি চর্চিত একটি বিয়োগান্ত নাটক। এই নাটকে ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেটের জীবনযুদ্ধের দ্বন্দ্ব ও সংকটময় রূপ চিত্রিত হয়েছে, যা কাহিনিবিন্যাস ও মর্মকথায় হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। চার শ বছর ধরে এই নাটকটি বিশ্বের অগণিত দেশে বিরতিহীনভাবে মঞ্চে অভিনীত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও এর আগে অনেকবার হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক কাহিনিবিন্যাস ও মূল গল্পের মর্মকথায় কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি।

নাটকটি দেখে মনে হয়েছে, শেক্‌সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ যেন হয়ে ওঠে এই বাংলার ‘হ্যামলেট’ তথা বাংলাদেশের ‘হ্যামলেট’। কাহিনির কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে সৈয়দ হক এতে যুক্ত করেছেন বাঙালি কবিদের কাব্যাংশ ও গান। পাশাপাশি এসেছে বাংলার নিজস্ব লোকজ পালাগানেরও নানা আঙ্গিক। ব্যবহৃত হয়েছে রবীন্দ্রসংগীতও। নৃত্যেও সচেতনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এ দেশীয় নৃত্য আঙ্গিক ও ভাবনা। দুই ঘণ্টার বেশি সময় নিয়ে নাটকটি দর্শক দেখেছেন মন দিয়ে। পুরোটা সময় মিলনায়তনে ছিল নীরবতা। আবার শেষ দিকে মন্ত্রীপুত্র লেয়ার্তেসের সঙ্গে হ্যামলেটের তরবারি নিয়ে যুদ্ধ এবং মৃত্যু পথযাত্রী লেয়ার্তেসের কথা শুনে যুবরাজ হ্যামলেট রাজা ক্লডিয়াসকে তরবারি দিয়ে আঘাত এবং বিষ মেশানো পানীয় পান করতে বাধ্য করার দৃশ্যের সময় দর্শকের করতালিও শোনা যায়। তবে কয়েকজন দর্শকের মন্তব্য নাটকটি আরও সংক্ষিপ্ত হতে পারত। এর কোরিওগ্রাফি আরও ভালো করা উচিত ছিল।

নাটকে হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাস্উদ সুমন, ক্লডিয়াস চরিত্রে শামীম সাগর, গারট্রুড চরিত্রে সংগীতা চৌধুরী, ওফেলিয়া চরিত্রে মেহেজাবীন মুমু, পলোনিয়াস চরিত্রে আমিনুর রহমান মুকুল অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া নাটকটি আরও অভিনয় করেছেন শফিকুল ইসলাম, যোজন মাহমুদ, মো. সোহেল রানা, শরীফ সিরাজ, বাপ্পি আমীন, তৃপ্তি রানী মণ্ডল, ফখরুজ্জামান চৌধুরী প্রমুখ।

নাটক দেখার জন্য দর্শকের দীর্ঘ সারি, জাতীয় নাট্যশালার করিডরে
নাটক দেখার জন্য দর্শকের দীর্ঘ সারি, জাতীয় নাট্যশালার করিডরে