গানের জগতে কেমন আছেন নজরুল

ফাতেমাতুজজোহরা, সুজিত মোস্তফা, ফেরদৌস আরা, তানভীর আলম সজীব
ফাতেমাতুজজোহরা, সুজিত মোস্তফা, ফেরদৌস আরা, তানভীর আলম সজীব

নজরুলসংগীতের চর্চা যেমনটা হচ্ছে, তা মোটেও সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। তারুণ্যের মধ্যে এই চর্চাটা আরও কম। কারণ, নজরুলসংগীতের চর্চা যাঁরা করেন, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে একটা পর্যায়ে তাঁদের থেমে যেতে হয়। সরকারি–বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগই পারে তারুণ্যের মধ্যে নজরুলসংগীতের চর্চা আরও বড় পরিসরে বিকশিত করতে। এমনটাই মনে করেন নজরুলসংগীতশিল্পী ফেরদৌস আরা।

কারও কাছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের কবি, কারও কাছে প্রেমের কিংবা তারুণ্যের কবি। বর্তমান সময়ে গানের জগতে কেমন আছেন নজরুল? কেউবা বলছেন ভালো, আবার কেউ বলছেন একেবারেই ভালো না। সংস্কৃতিজগতে তরুণদের মধ্যে নজরুলকে ছড়িয়ে দিতে হলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে আরও বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু তাই নয়, বছরের সুনির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময়েও নজরুলের জীবনদর্শন নিয়ে আলোচনা করতে হবে। গণমাধ্যমে ফলাও করে তুলে ধরলেই তবে নতুন প্রজন্মের কাছে আরও ভালোভাবে থাকবেন জাতীয় কবি।

বর্তমান সময়কে ক্রান্তিকাল উল্লেখ করে শিল্পী সুজিত মুস্তাফা বলেন, ‘দেশে অনেক অবকাঠামোর পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল প্রকৃত মানুষ গড়ার, যেখানে আমরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। প্রযুক্তির একটা ভয়াবহ পরিবর্তন হয়েছে। এতে করে মানুষের মনোজগতের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও হয়েছে। সবাই নিজের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য প্ল্যাটফর্ম পেয়ে গেছেন। কথা বলার অধিকার আছে, কিন্তু অনেকেই পরিমিতিবোধের ব্যাপারটি ভুলে গেছেন। এখানে আমাদের একটা বড় শূন্যতা আছে।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আদৌ সেভাবে স্মরণ করা হচ্ছে না। শুধু জন্মদিন ও মৃত্যুদিবসে তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সবাই। করপোরেট সোসাইটিও নজরুলের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না বলে জানান সুজিত মুস্তাফা। নজরুল নিয়ে অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায় না। তাঁর চেতনাকে ধারণ করে তেমন কিছু করা হচ্ছে না বলে মনে করেন সুজিত মুস্তাফা। তিনি বলেন, ‘নজরুলসংগীত সহজ কোনো বিষয় না। অনেক পরিশ্রম করে করার বিষয়। নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষাগত জায়গা থেকে তৈরি হওয়ার বিষয়টি দেখছি না।’

রাষ্ট্রের উদ্যোগে নজরুল ইনস্টিটিউট চলছে, কিন্তু সেখানে সুন্দর পরিকল্পনা এবং সম্মিলিত ভাবনার প্রকাশ থাকা উচিত বলে মনে করছেন তিনি।

অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে তরুণেরা নজরুলসংগীতের চর্চা করছেন বলে মনে করেন ফাতেমাতুজজোহরা। তবে তা একান্তই নিজেদের তাগিদ থেকে। সেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা নেই। ফাতেমাতুজজোহরা বলেন, ‘তরুণদের গান গাইবার প্ল্যাটফর্ম দিতে হবে। যারা নজরুলের গানের চর্চায় যুক্ত হয়, নাম–যশ অর্জনের জন্য তারা পরিশ্রমের রাস্তা এড়িয়ে যায়। গণমাধ্যমেরও উচিত ওদের সমান সুযোগ দেওয়া।’

দেশের তরুণেরা ভেতরে ভেতরে নজরুলসংগীতের চর্চা করে চলছেন। তবে সংখ্যাটা কম। বিকাশের সুযোগ করে না দিলে তাঁরা এগিয়ে যেতে পারবেন না বলে মনে করেন ফাতেমাতুজজোহরা। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের অনেক কিছু ছেড়ে দিয়ে নজরুলসংগীতে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। এখনকার তরুণেরা তো সে রকম ধৈর্য ধারণ করতে পারবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবেও সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। ঢাকা শহরের বাইরেও অনেকের মধ্যে নজরুলের গান করার আগ্রহ আছে। এদের লালন না করলে একটা সময় আগ্রহ মরে যাবে।’

নিরলসভাবে নজরুলসংগীত শিক্ষা দেওয়ার কাজটি করছেন ফেরদৌস আরা। তিনি বলেন, ‘আমরা যাঁরা শিক্ষক, বুঝতে পারি, তরুণদের মধ্যে নজরুল কতটা উদ্দীপনা জাগিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এটা আরও বেশি দরকার। সারা বিশ্বের যাঁরাই বাংলাকে চর্চা করে থাকেন, তাঁরা নজরুলের আদর্শ ও চেতনা নিয়ে ভাবেন। সাম্প্রতিক বিশ্বে তিনি এখনো আধুনিক।’

নজরুলের গানের শিল্পী হিসেবে তরুণদের নিয়ে নিরীক্ষাও করছেন তানভীর আলম সজীব। তিনি মনে করেন, ‘এখনকার তরুণেরা অনেক স্মার্ট। গানের ক্ষেত্রে তারা অনেক এক্সপেরিমেন্ট করছে। ১০ বছর আগেও এমনটা ছিল না। তবে যেভাবে নজরুলের গান নিয়ে তরুণেরা ভাবছে, সেভাবে এসব কাজ লালন করার মতো মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিভার মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বছরে দুই দিন নজরুল ও তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একচেটিয়া কথা হবে, এরপর আমরা সবা ভুলে যাব। এটা আসলে জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিনে কথা বলার নয়, সারা বছর ভাববার বিষয়।’