টিভি নাটকে ঘুরেফিরে একই মুখ

রিলেশনশিপ নাটকের দৃশ্যে অপূর্ব ও মেহ্‌জাবীন
রিলেশনশিপ নাটকের দৃশ্যে অপূর্ব ও মেহ্‌জাবীন

টেলিভিশন নাটকে ঘুরেফিরে একই মুখ পর্দায় দেখা যায়। হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পীকে ঘিরেই নাটকগুলো তৈরি হচ্ছে। এতে নাটকের বৈচিত্র্য যেমন হারাচ্ছে, তেমনি বিরক্ত হচ্ছেন দর্শকেরাও। বর্তমান নাটকের এটিও একটি সংকট হিসেবে মানছেন পরিচালকেরা। ভালো গল্পের অভাব, অভিনয়শিল্পী পছন্দের ক্ষেত্রে লগ্নিকারীদের বাধ্যবাধকতা, প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণে নাটক বানানোর বিষয়টিও উঠে এসেছে কারণ হিসেবে। অনেকে বলছেন, দর্শক চাহিদা মাথায় রেখে শিল্পী বাছাইয়ের কারণে একই শিল্পীকে দেখা যায় বেশির ভাগ নাটকে।

এবারের ঈদে কয়েকজন অভিনয়শিল্পীর মুখই ভেসে উঠেছে বারবার। টেলিভিশন, ইউটিউব, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে একই শিল্পী। তাঁদের মধ্যে জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, নুসরাত ইমরোজ তিশা, মম, তাহসান, অপূর্ব, আফরান নিশো, মেহ্জাবীন চৌধুরী, ইরফান সাজ্জাদ, শবনম ফারিয়া, তৌসিফ, সাবিলা নূর, তানজিন তিশা প্রমুখ অন্যতম। তাঁদের কেউ কেউ আবার এবারের ঈদে ৩০টির বেশি নাটকে কাজ করেছেন।

পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর ধরে আমরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি। এবার কিন্তু নাটকের গল্পের বৈচিত্র্য ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পী নির্বাচন হয় প্রযোজক, চ্যানেল অথবা অর্থলগ্নিকারীদের পছন্দে! গল্পের প্রয়োজনে, চরিত্রের প্রয়োজনে পরিচালককে শিল্পী বাছাই করতে হয়। এটা না হওয়ার ফলে এই হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়েই আড়াই শ থেকে তিন শ নাটক প্রতি ঈদের সময় তৈরি হয়। এতে দর্শকও বিরক্ত হয়। নাটক থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার এটাও একটা বড় কারণ।’
ভিন্নধর্মী গল্পের নাটক বানিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন রেদওয়ান রনি। তিনি বলেন, ‘এক মৌসুমে এত নাটক বানানোর কী দরকার! একজন দর্শক একটা মৌসুমে ১০ থেকে ২০টা নাটক দেখে। এত নাটকের অভিনয়শিল্পী আর লেখকও তো আমাদের দেশে নেই। তাই একই মুখ তো বারবার আসবে।’

তানজিন তিশা ও আফরান নিশো অভিনীত নাটক থ্যাংক ইউ
তানজিন তিশা ও আফরান নিশো অভিনীত নাটক থ্যাংক ইউ

কোনো পরিচালক আবার এক ঈদে ২০টির মতো নাটকও বানিয়েছেন। রনি প্রশ্ন তোলেন, ঈদের মতো উৎসবে একজন পরিচালকের পক্ষে কয়টা ভালো নাটক বানানো সম্ভব? তিনি বলেন, হয়তো একজন পরিচালক ১০টা নাটক বানাচ্ছেন। তার মধ্যে ২টা নাটকে মনোযোগ দিতে পারছেন। বাকিগুলো বানানোর জন্য বানানো হলো। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত নাটক যখন আপনি বানাবেন, তখন তার মান খারাপ হতে থাকবে। একই জিনিস ঘটছে অভিনয়শিল্পীদের ক্ষেত্রেও। একটা চরিত্র তৈরিতে তিনি কতটুকু সময় দিচ্ছেন? একটা মৌসুমে যে পরিমাণ নাটক একজন অভিনয়শিল্পী করছেন, তাতে চরিত্রটির প্রস্তুতির জন্য যে সময় দরকার, তা তো দিতে পারছেন না। কারণ, তাঁর কাছে অনেক নাটকের প্রস্তাব। সুতরাং মান খারাপ হবে, এটাই স্বাভাবিক।

বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আখন্দ বলেন, ‘এ প্রসঙ্গে দ্বিমত করার খুব একটা সুযোগ নেই। তবে আমাদের চ্যানেল নিয়ে বলব, এবারের ঈদের নাটকে বৈচিত্র্য ছিল। গল্পের ক্ষেত্রে আমরা শুধুই দুটি চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম না। পরিবারের অন্য সদস্যদের উপস্থিতি ছিল নাটকে। দর্শক যাঁদের দেখতে চায়, মূলত তাঁদের নিয়েই নাটক পরিকল্পনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। একজন তারকারই অধিক নাটক, অন্যদের নেই—এমনটি যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখেছি। আমরা চেষ্টা করেছি, পরিমিতিবোধ যাতে বজায় থাকে।’
পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, এমন প্রশ্নে সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘অবশ্যই পরিকল্পনা আছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংগঠনগুলোর নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন আমরা ইন্ডাস্ট্রির নিয়মশৃঙ্খলা নিয়ে কথা বলছি। শিগগিরই সব সংগঠন মিলে একটি আলোচনা হবে। সেখানেও এসব বিষয় নিয়ে কথা হবে। আশা করছি, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই ইন্ডাস্ট্রিতে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাবেন।’

নতুন প্রজন্মের অভিনয়শিল্পী শবনম ফারিয়ার মতেও উৎসবে অনেক নাটক হয় এবং সুনির্দিষ্ট কয়েকজন তারকার ওপর চাপ থাকে। প্রস্তুতির ব্যাপার যদিও কমবেশি থাকে, তবে যতটা থাকার দরকার, তা নেওয়া সম্ভব হয় না অনেক কাজের চাপে।
পরিচালক রেদওয়ান রনি এই সংকট উত্তরণের পথ বাতলে দিতে গিয়ে বলেন, শিল্পী–পরিচালক–প্রযোজক সবাইকে সচেতন হতে হবে। শিল্পী বাছাই করে কাজ করবেন। কয়েকজন পরিচালক আছেন, তাঁরা একটা–দুইটা কাজ করেন। সেটা আলোচিত হয়। তাঁরা সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলছেন যে কম বানাবেন, কিন্তু ভালো বানাবেন। এর বাইরের বিশাল পরিমাণ কাজ থাকে, যেগুলো দর্শক দেখেন না, আলোচনাও হয় না, বরং তিক্ততা তৈরি হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, এই কাজগুলোর দরকার কী? চ্যানেলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে,মানহীন নাটক তারা প্রচার করবে না।