ভিউ পেতে নাটকের উদ্ভট নাম

নিয়মিত নির্মিত হচ্ছে এ ধরনের উদ্ভট নামের নাটক
নিয়মিত নির্মিত হচ্ছে এ ধরনের উদ্ভট নামের নাটক

নাম নয়, কাজে পরিচয়—আগে গুরুজনেরা ছোটদের এ কথা বলতেন এটি বোঝাতে যে, নাম যত ভালোই হোক না কেন, মানুষের মূল পরিচয় আসলে তার কাজে। তবে ইদানীং বাংলা নাটকের নাম দেখে অনেকে ভিরমি খাচ্ছেন। বলছেন, রুচি ও মানের বিচারে নামও গুরুত্বপূর্ণ। নামেও আসলে অনেক কিছু যায়–আসে।

নাটকের মান নিয়ে প্রশ্ন অনেক আগেই উঠেছিল। মানহীন নাটকের কারণে দর্শকেরা দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এবার পড়তি মান, নিম্নমানের গল্প, অভিনয়, অত্যধিক বিজ্ঞাপন বিরতির পাশাপাশি যোগ হয়েছে নতুন বিরক্তি—উদ্ভট নাম।

ইউটিউব খুঁজে সাম্প্রতিক কালের কয়েকটি নাটকের নাম পাওয়া গেল—সেন্ড মি নুডস, বেড সিন, ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা, সেইরকম বাকিখোর, চুটকি ভান্ডার, সেলিব্রেটি কাউ, মিউচুয়াল ব্রেকআপ, লেডি কিলার, প্লেবয়, ক্রেজি লাভার, ড্যাশিং গার্লফ্রেন্ড, বংশগত পাগল, ম্যানেজ মকবুল, চ্যাতা কাশেম, হেভিওয়েট মিজান, এক্সফেল মফিজ, মফিজের লাইফস্টাইল। এর মধ্যে কিছু নাটক ইউটিউবের জন্যই তৈরি হয়েছিল। আবার কিছু নাটক বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচারিত হওয়ার পর ইউটিউবে এসেছে।

নাটকগুলোর এমন নাম শুনে রীতিমতো বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নাট্যজনেরা। এ সময়ের কয়েকজন পরিচালকও এ ধরনের নামের বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। অনেকে নাটকের এমন উদ্ভট ও অরুচিকর নামকরণকে পরিচালকদের সৃজনশীলতা ও শিক্ষার অভাবকে দায়ী করছেন।

বরেণ্য অভিনয়শিল্পী আবুল হায়াত বললেন, ‘একটা সময় প্রমিত বাংলায় মানুষ কথা বলত। টিভি নাটক দেখে বাচ্চারা কথা বলা শিখবে—সেই জায়গা থেকে আমরা নাটক করতাম। এখন নাটকের নাম শুনলেই মোটামুটি সব বোঝা যায়। ভাষাটাই যেখানে হারিয়ে গেছে, নাম নিয়ে আর কী আশা করতে পারি।’

অথচ আশি ও নব্বইয়ের দশকের নাটকগুলো নিয়ে এখনো দারুণ সব প্রতিক্রিয়া পান আবুল হায়াত। তিনি বলেন, ‘এখনো বুঝি, দর্শক ওই রকম গল্প চায়। আমরা ভাঁড়ামি গেলাতে চাইছি। জানি না, কীভাবে বেরিয়ে আসা যাবে এখান থেকে। এখানে টেলিভিশন চ্যানেলের দায় অনেক।’

সব নাটকের নাম এমন, তা নয়। এই শহরে, আমাদের সমাজবিজ্ঞান, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মায়া সবার মতো না, কাঠপেন্সিলের কাহিনি, তুমি ফিরে আসোনি, আগন্তুক, ফেরা, শুনতে কি পাও-এর মতো নামের নাটকও আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, ঘুরেফিরে একই অভিনয়শিল্পীরা এই দুই ধরনের নাটকগুলোতে অভিনয় করছেন।

নাট্যজন মামুনুর রশীদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইদানীং বেশির ভাগ নাটকে যে ধরনের নাম দেওয়া হয়, এগুলো অসভ্য লোকের বর্বর কাজ। আমাদের দুঃখ ছিল, টেলিভিশন নাটক তো গেল, এখন ইউটিউব আরও জঘন্য। নাটকের নামের এই বিকৃতির পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁদের শাস্তি দেওয়া উচিত।’

নাটকের বাজেট কম, এ কারণেই কি নামের এই হাল? মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এখানে বাজেট বিষয় নয়। এ ধরনের নাম কিছু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ পছন্দ করে, যার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়ে। শুনেছি, যাঁরা অনুষ্ঠান বিভাগে আছেন, তাঁরা এমনও বলেন, নাটকে মজা কোথায়, মজা বের করেন। আমরা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে একটি নাটক বানাচ্ছিলাম, মজা নেই বলে চ্যানেল সেই নাটকের প্রচার বন্ধ করে দেয়।’

বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আখন্দ বলেন, এ ধরনের নামের বিষয়টি মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। ইউটিউব প্রকাশের সুযোগ তৈরি হওয়ার পর লাখ-কোটি ভিউর আশায় অনেকে ‘ক্যাচি’ (আকর্ষণকারী) নাম দিতে গিয়ে এ পথে নেমেছেন। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শিল্পী, পরিচালক থেকে শুরু করে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

অভিযোগ আছে, নাটকের নাম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা অনেক পরিচালক ও টিভি কর্মকর্তারা বুঝতে চান না। এর পরিণতি খারাপ হবে বলে মনে করেন নাটকসংশ্লিষ্ট অনেকে। তাঁদের আশঙ্কা, ২০০০ সালের দিকে গুটিকয়েক লোক উদ্ভট গল্প, আনাড়ি অভিনয়শিল্পী দিয়ে অরুচিকর নামের সিনেমা বানিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। নাটকেও সেই অবস্থা হতে চলেছে। নাটকে এখন পাল্লা দিয়ে চলছে উদ্ভট সব কনটেন্ট বানানোর প্রতিযোগিতা। উদ্দেশ্য, লাখ লাখ ভিউ এনে রোজগার করা।

গত ঈদে দুটি নাটক বানিয়েছেন আশফাক নিপুণ। নির্মিত নাটকের নাম নিয়ে তিনি ইদানীং লজ্জিত। তিনি বলেন, ভালো নামের পেছনে সময় দিতে হয়। কিন্তু পরিচালকেরা দৌড়াচ্ছেন, ডজন ডজন নাটক বানাচ্ছেন। সবার ধারণা, একটা ক্যাচি নাম দিয়ে দিলেই হলো। কিন্তু ক্যাচি নাম তো অর্থপূর্ণ, নান্দনিক হতে হবে। বাংলা ভাষা তো নান্দনিক।’