হেভি মেটালের তীর্থস্থানে ট্রেইনরেক

এবারের ওয়াকেন ওপেন এয়ারের জনস্রোত
এবারের ওয়াকেন ওপেন এয়ারের জনস্রোত
>ওয়াকেন ওপেন এয়ার হলো হেভি মেটাল ব্যান্ডের তীর্থস্থান। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই হেভি মেটাল উৎসব শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে। প্রতিবছর আগস্টের শেষ চার দিন এর আসর বসে জার্মানির হামবুর্গ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরত্বের ওয়াকেন গ্রামে। এ বছর ১–৩ আগস্ট বসেছিল এর জমজমাট আসর। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশের ২০০–এর বেশি ব্যান্ড অংশ নেয় এতে। প্রথম বাংলাদেশি ব্যান্ড হিসেবে ওয়াকেন ওপেন এয়ারে নাম লেখায় ‘ট্রেইনরেক’। সে অভিজ্ঞতার কথা বললেন ব্যান্ডটির সদস্য এ কে রাহুল 

ওয়াকেনের অভিজ্ঞতা বলার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলি। জার্মানি থেকে ফেরার পর অফিসে যোগ দিয়েছি। নতুন অফিস, বেতনের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিতে হবে। ফরমে সব লিখে দিলাম। কিন্তু দুদিন পরও অ্যাকাউন্টে বেতন জমা হলো না। ঘটনা কী? খোঁজ নিয়ে দেখি, ভুল নম্বর দিয়ে বসে আছি। ব্যাংকে গিয়ে সব ঠিকঠাক করার কথা ভাবতেই গায়ে যেন জ্বর এল। তারপরও সকাল সকাল ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। হঠাৎ ব্যাংকের এক কর্মী এসে বললেন, ‘আপনাকে তো চিনি, আপনি ট্রেইনরেকের সদস্য না? কদিন আগে ওয়াকেনে গিয়েছিলেন…।’ আমি তো আনন্দে বিগলিত হয়ে বললাম, ‘জি ভাই, জি ভাই!’ ব্যস, খুব অল্প সময়ে মুশকিল আসান হয়ে গেল।

ট্রেইনরেক ব্যান্ডের সদস্যরা
ট্রেইনরেক ব্যান্ডের সদস্যরা

ওয়াকেন থেকে ফেরার পর দেশের মানুষ আমাদের চিনছে, এটা পরম পাওয়া। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও হেভি মেটাল জনপ্রিয় ঘরানার সংগীত নয়। এর চর্চা কম, শ্রোতাও কম—তবে যারা শোনে তারা হৃদয়ে ধারণ করে। ফলে নিজেদের আমরা ব্যাকবেঞ্চার হিসেবে মেনে নিই। ব্যাকবেঞ্চাররা ফাইনাল পরীক্ষায় দুম করে ভালো কিছু করে বসলে সবাই বিস্ময়মিশ্রিত ভালোবাসায় বুকে টেনে নেয়। আমাদের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। এখন রাস্তায় বের হলে মানুষ বলে, ‘ওই যে ট্রেইনরেকের মেম্বার যায়!’ কেউ আসে সেলফি তুলতে। ব্যাপারটা নেহাত মন্দ নয়!

ওয়াকেন ওপেন এয়ারে দেড় লাখ ডলার সমমূল্যের এই বাসেই থেকেছেন ট্রেইনরেকের পাঁচজন
ওয়াকেন ওপেন এয়ারে দেড় লাখ ডলার সমমূল্যের এই বাসেই থেকেছেন ট্রেইনরেকের পাঁচজন

গত বছরের আগস্ট মাসের দিকে খেয়াল করলাম, বাংলাদেশে ‘ওয়াকেন ব্যাটল’ হবে। রীতিমতো লাফ দিয়ে উঠলাম। হেভি মেটাল ব্যান্ডের তীর্থস্থান ওয়াকেন ওপেন এয়ারে যাওয়ার এই তো সুযোগ। ব্যান্ডে যোগ দেওয়ার আগে থেকে এই উৎসবের ব্যাপারে জানাশোনা। ২০০৮ সাল থেকে রীতিমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফলো করি। স্বপ্নের সে আসরে যেতে হলে প্রতিযোগিতায় জিততে হবে। শুরু হলো আমাদের প্রস্তুতি। দেশের ৮৭টি ব্যান্ডের মধ্য থেকে আমরা বিজয়ী হয়ে পেলাম বেঙ্গালুরু ওপেন এয়ারের টিকিট। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের ব্যান্ডগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামলাম আমরা। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাফোকেশন’ এবং নরওয়ের ‘অ্যাবাথ’–এর মতো দুটি বিশ্বখ্যাত ব্যান্ডের সঙ্গে বাজানোর সুযোগও পেলাম সেখানে। অবশেষে ৯ ফেব্রুয়ারি এল মঞ্চে কেঁদে দেওয়ার মতো এক মুহূর্ত। আমরা যে স্বপ্ন মাথায় নিয়ে বেড়ে উঠেছি, সে স্বপ্ন সত্যি করার ছাড়পত্র এল আমাদের হাতে। আমাদের বলতে আবির আহমেদ, ইকরাম ওয়াসি, হাবীবুল্লাহ ফারহান, মার্ক ডন ও আমার হাতে। নিঃসন্দেহে ১০ বছরের যাত্রায় ট্রেইনরেকের সবচেয়ে বড় সাফল্য এটাই।

ওয়াকেন ওপেন এয়ারে দেড় লাখ ডলার সমমূল্যের এই বাসেই থেকেছেন ট্রেইনরেকের পাঁচজন
ওয়াকেন ওপেন এয়ারে দেড় লাখ ডলার সমমূল্যের এই বাসেই থেকেছেন ট্রেইনরেকের পাঁচজন

তবে ঝামেলা হয়ে গেল ডন ব্যান্ড থেকে চলে যাওয়ায়। রীতিমতো কপাল চাপড়াতে হলো। কী করা যায়? ওয়াকেনে দুই শর বেশি ব্যান্ড বাজাবে। যেনতেন কাউকে তো সঙ্গে নেওয়া যায় না। ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম পাওয়ারসার্জ ব্যান্ডের ড্রামার আসিফ মাহমুদকে। শুরু হলো অফিস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে আমাদের কঠিন প্রস্তুতি। উত্তরায় আমার নিজের স্টুডিও এবং নুমাইরি ভাইয়ের ফানকাডেলিক মিউজিশিয়ানস প্র্যাকটিস প্যাডে চলল নিজেদের ঝালাই করে নেওয়ার পর্ব। সাড়ে তিন মাসের খাটাখাটুনি শেষে এল জার্মানির ডাক।

জার্মানিতে গিয়েই ২৭ জুলাই পেলাম ওয়াকেন ওয়ার্মআপ পার্টিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ। হামবুর্গে কাইজারকেলার নামের একটি ক্লাব আছে। ১৯৬০ সালে সেখানে বাজিয়েছিল বিটলস ব্যান্ড। বিশ্বখ্যাত এই ব্যান্ডটি যে মঞ্চে বাজিয়েছিল ঠিক সেখানেই উঠলাম আমরা। মানুষ বলল, জানো, এই রাস্তা দিয়ে বিটলস সদস্যরা হেঁটে গিয়েছিলেন! সেই রাস্তায় পা রাখতেই মনে হলো, এই মাটিতে গর্ব মিশে আছে। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো, ভিনদেশিরা আমাদের প্রশংসা করল প্রাণ খুলে। ওখানে নিয়ম হলো, যে ব্যান্ড ভালো করবে তাদের টি–শার্টই বেশি বিক্রি হবে। আমাদের সঙ্গে সেখানে কম্বোডিয়া, লেবানন ও ফিলিপাইনের তিনটি ব্যান্ড অংশ নিয়েছিল। বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, সেদিন আমাদের টি–শার্টই বেশি বিক্রি হয়েছিল।

ওয়াকেন ওপেন এয়ারে দেড় লাখ ডলার সমমূল্যের এই বাসেই থেকেছেন ট্রেইনরেকের পাঁচজন
ওয়াকেন ওপেন এয়ারে দেড় লাখ ডলার সমমূল্যের এই বাসেই থেকেছেন ট্রেইনরেকের পাঁচজন

অবেশেষে এল ১ আগস্ট। ওয়াকেনের মঞ্চে পা রাখলাম আমরা। মঞ্চে একেক ব্যান্ড একেক রকমভাবে শুরু করে। আমরা বলাবলি করছিলাম, ওয়াকেনের মঞ্চে কেবল ট্রেইনরেক উঠবে না, বাংলাদেশও উঠবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেটাল উৎসবের মঞ্চে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি আমরা। তাই শুরুটা হোক আমাদের জাতীয় সংগীত দিয়েই। তারপর কী যে হলো, তা নিশ্চয়ই অনেকেই জানেন। মুহূর্তের মধ্যেই ফেসবুকে ছোট্ট ওই ক্লিপটি ভাইরাল হলো, মানুষ তা দেখে দারুণ আপ্লুত। মঞ্চ থেকে নামার পর ফেসবুকে ঢুকে দেখি, দেশে বসে মানুষ ট্রেইনরেকের জন্য কেবল শুভকামনাই জানাচ্ছে। ক্রিকেট দল ভালো করলে যেমনটা হয়, সেদিন ঠিক ও রকমই লাগছিল। আর মঞ্চের সামনের পরিবেশ ছিল এককথায় উন্মাতাল। ‘স্লেয়ার’, ‘ওপেথ’, ‘পার্কওয়ে ড্রাইভ’, ‘হ্যামারফল’, ‘অ্যানথ্রাক্স’ কিংবা ‘টেস্টামেন’–এর মতো বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড যেখানে বাজিয়েছে, সেখানে বাজিয়েছি আমরা—এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আপাতত আর কিছু নেই। আর ওয়াকেনে আমাদের থাকার জায়গা বলতে ছিল বিশাল এক বাস। যে বাসের ভেতরে থাকা–খাওয়া সবকিছু। পরিবার ছেড়ে আমরা পাঁচজন একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি সপ্তাহ দুয়েক। অভিজ্ঞতার ভান্ডারে অনেক কিছুই জমা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো পেশাদারিত্ব ও উদারতা। ওয়াকেনে কেউ জানতে চায় না, তোমার ধর্ম কী; কেউ বলে না, ওর গায়ের রং কালো বা সাদা। সবার সুর একটি তারেই বাঁধা—হেভি মেটালের প্রতি ভালোবাসা। দেশে যারা হেভিমেটাল চর্চা করে, তাদের মধ্যে এই দুই অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে চাই আমরা।

অনুলিখন: মাহফুজ রহমান

● ট্রেইনরেকের ওয়াকেন জয়ের ভিডিও দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে